Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

১৯৭১ : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ নিউজলেটার

১৯৭১-এ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ প্রশ্নে সরকার বনাম জনগণ এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। সেখানকার সরকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারকেই পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে গেছে, সহযোগিতা করেছে, অস্ত্র ও সৈন্য পরিবহনেও এগিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং নিক্সন প্রশাসনবিরোধী কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরগণ বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সমর্থন জানিয়েছেন, বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সহায়তা করেছেন। এ সময় বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার শিকাগো শাখা থেকে ইংরেজিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ নিউজলেটার একাত্তরের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। এই নিউজলেটার থেকে নির্বাচিত কিছু সংবাদ ও মতামত ভাষান্তরিত করা হলো :

পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক (১৭ মে ১৯৭১)
২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর আক্রমণের বেপরোয়া আগে আমাদের প্রায় সবারই পশ্চিম পাকিস্তানি কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সব পশ্চিম পাকিস্তানিই আমাদের শত্রæ, এ কথা অবশ্যই সত্য নয়। অনেকেই আছেন যারা আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছেন (ফিরোজ আহমেদ সম্পাদিত ‘পাকিস্তান ফোরাম’ এপ্রিল-মে ১৯৭১ সংখ্যা দেখুন)।
আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। যত বেশি সম্ভব মিত্র আমাদের প্রয়োজন হবে। রণাঙ্গনের বিজয় দিয়ে যেমন স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত করতে পারি, পশ্চিম পাকিস্তানি বন্ধুদের পক্ষে এনেও তা দ্রুততর করতে পারি। যুদ্ধজয়ে তারাও আমাদের সহায়তা করতে পারে।
আমরা কারণটা বুঝতে পারি কেন এখানকার অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানির সমর্থন আমরা পাচ্ছি না- প্রথমত, তারা পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে অবহিত নয়, দ্বিতীয়, পাকিস্তান দূতাবাস মিথ্যে প্রচারণা চালিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করছে।
বর্তমান সংকট সম্পর্কে তাদের অবহিত করার দায়িত্ব আমাদের। আমরা নিশ্চিত যখন তারা আমাদের দিককার কথা জানতে পারবে তারা তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে। আমাদের পরামর্শ তাদের আমরা তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের কপি সরবরাহ করব, তাতে সংকটের প্রেক্ষাপট বর্ণিত। যদি আপনাদের কাছে কপি না থাকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ‘বাংলাদেশ : সিচুয়েশন এন্ড অপশন’ নামে ড. রেহমান সোবহানের লেখাটিও নামমাত্র মূল্যে আমরা সরবরাহ করব।

নিউইয়র্কে সমাবেশ (১৩ জুন ১৯৭১ প্রকাশিত)
নিউইয়র্ক, ১২ জুন ১৯৭১ : বাংলাদেশ লীগ ফর আমেরিকা, বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এসোসিয়েশন এবং ইন্ডিয়ান অর্গানাইজেশনের সম্মিলিত উদ্যোগে ১২ জুন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আনুমানিক ১০০০ জন প্রতিনিধি এতে যোগ দেন। এই সমাবেশে বক্তাদের মধ্যে ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, ড. ইকবাল আহমেদ, উইলিয়াম রায়ান, ড. প্ল্যাস্টিক, অ্যান টেয়লর, ড. আলমগীর এবং এ পুলি। এতে সভাপতিত্ব করেন অশীতিপর বৃদ্ধ স্বাধীনতা যোদ্ধা পিসি মুখার্জি।
ভারত থেকে আগত সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ তার ভাষণে বলেন, যতক্ষণ না পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাদের বাধ্য করেছে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করতে চায়নি। তিনি মনে করেন এখন যেহেতু বিষয়টির সঙ্গে জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাও অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তিনি বিশ্ববাসীর কাছে এবং বিশেষ করে মুক্ত বিশ্বের নেতাদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তারা যেন তাদের আনুষ্ঠানিক দাপ্তরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনগণের ইচ্ছে অনুযায়ী অবিলম্বে এ অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর দায় তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোর ওপর চাপালেন। তিনি সতর্ক করে দিলেন বৃহৎ শক্তিগুলো যদি পূর্ব বাংলার লাখ লাখ মানুষের আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে না আসে তা হলে বাঙালিদের যাতনার দায় তাদেরই বহন করতে হবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ড. ইকবাল আহমেদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার যে নির্মমতার রাজত্ব কায়েম করেছে তার জন্য গভীর নিন্দা জ্ঞাপন করেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের চরম ফ্যাসিস্ট সরকার আখ্যায়িত দেন। তিনি বাঙালিদের স্বশাসনের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
সমাবেশে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রতিনিধি উইলিয়াম রায়ান বাঙালিদের অধিকার ও দাবি সম্পূর্ণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে প্রদেয় সব ধরনের সহায়তা স্থগিত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বাঙালিদের দাবি আদায়ের জন্য তার অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্ল্যাস্টিক পূর্ব বাংলার অধিকার অর্জনে এবং শান্তি পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ করার আবেদন জানান। তিনি বলেন, বাঙালিদের অধিকার অর্জনের আগে পাকিস্তানের যদি সাহায্য অব্যাহত রাখে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অধিকার দাবিয়ে রাখার অপরাধে পাকিস্তানের দুষ্কর্মের সহযোগী হিসেবে পরিচিত হবে।
ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক অ্যান টেয়লর ইতোপূর্বে বাংলাদেশের জন্য ওয়াশিংটনে অনশন, ধর্মঘট করেছিলেন। নিরস্ত্র বাংলার মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার তিনি প্রত্যক্ষদর্শী; সমাবেশে তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা শোনান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিবেকবান মানুষের কাছে নিবেদন জানান তারা যেন বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার ড. আলমগীর যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে অনুরোধ রাখেন বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া এবং পাকিস্তানের শেষ সৈন্যটি সেখান থেকে প্রত্যাহার করে না নেয়া পর্যন্ত তারা যেন পাকিস্তানকে যে কোনো ধরনের সহায়তা প্রদান করা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে নিরস্ত রাখেন।

যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বাঙালির রক্ত
বাংলাদেশ ওয়েস্ট কোস্ট নিউজ বুলেটিন, ক্যালিফোর্নিয়া, ২য় সংখ্যার সম্পাদকীয় অনূদিত হচ্ছে : শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাঙালির রক্ত হাতে লাগাল। এটা দুঃখজনক যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ স্বাধীনতার নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মেলাবে, যে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যত্র গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে, সেখানে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করছে।
পৃথিবীর ক্রোধের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের পুনরায় অনুরোধ উপেক্ষা করে দুই জাহাজ ভর্তি অস্ত্র পাঠিয়ে মানবিকতার নির্লজ্জ অসম্মান দেখিয়ে পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশ) পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মম নির্যাতনের সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের করের টাকায় অস্ত্র ইয়াহিয়ার জান্তব নেকড়ের পালের কাছে পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার দেশের জনগণকে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় অনিচ্ছুক অংশগ্রহণকারীতে পরিণত করেছে। এটা নিরস্ত্র বাঙালিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমতুল্য এবং নিক্সন প্রশাসন কর্তৃক মার্কিন জনগণের প্রতি নৈরাশ্যজনক প্রতারণা।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা মার্কিন জনগণের হাততালি পেতে পারে এবং লীগ সদস্য ও তাদের বন্ধুরাও শত্রæপক্ষকে সরাসরি মার্কিন সহায়তা প্রদান ও শক্তিশালী করার পরও ক্রমবর্ধমান বৈরিতার মুখে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা বাংলাদেশ লীগ এবং মার্কিন জনগণের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার সরকারের আবেদন জানাচ্ছি, তারা যেন মানবতার শত্রæদের সহায়তা স্থগিত করেন এবং বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত ইয়াহিয়া এবং সামরিক জান্তাকে সব ধরনের সহায়তার আবেদন প্রত্যাহার করেন।

কনসার্ট (১ জুন ১৯৭১)
বিখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ আলী আকবর খান, আমেরিকান জাজ মিউজিশিয়ান জন হ্যান্ডি এবং তবলাবাদক জাকির হোসেন ২৮ মে ১৮৭১ বার্কলেতে একটি কনসার্টে অংশগ্রহণ করেন। কনসার্টের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে অবস্থানকারী শরণার্থীদের সহায়তা প্রদান। এই অনুষ্ঠানে টিকেট বিক্রি থেকে প্রায় ৩ হাজার ডলার এবং তাৎক্ষণিক অনুদান হিসেবে আরো প্রায় ৫০০ ডলার পাওয়া যায়।

আরো কূটনীতিকের আনুগত্য প্রকাশ
নিউজলেটারের একাদশ সংখ্যায় (১৫ অক্টোবর ১৯৭৫) প্রকাশিত সংবাদ : অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ১১৪ জন কূটনীতিবিদ ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্প্রতি যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আর্জেন্টিনায় নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমিন, যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনারের পলিটিক্যাল কাউন্সেলর এম এম রেজাউল করিম, নয়া দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের মিনিস্টার-কাউন্সেলর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, বৈরুতের আবদুল লতিফ, মাদ্রিদে আবদুল করিম মণ্ডল, বেলজিয়ামে নায়েবুল হুদা এবং নেপাল দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি মুস্তাফিজুর রহমান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গ্রেপ্তার, চাকরিচ্যুত
শিকাগো থেকে বাংলাদেশ নিউজলেটার একাদশ সংখ্যাটি ২৫ অক্টোবর ১৯৭১ প্রকাশ হয়। এতে একটি দেশীয় সংবাদ মুদ্রিত হয়। মেষের ছদ্মবেশ থেকে বেরিয়ে আসা নেকড়ের মতো অভ্রান্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণার প্রকৃত চিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কথিত স্ক্রিনিং চালানো হয়েছে শিক্ষকদের ওপর। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর ৫ জনকে গ্রেপ্তার, ৩ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৩ জনকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছেন :
১. অধ্যাপক আহসানুল হক, ইংরেজি বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
২. অধ্যাপক কে এম সাদউদ্দিন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সম্পাদক।
৩. অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বাংলা বিভাগ।
৪. অধ্যাপক শহীদুল্লাহ, গণিত বিভাগ।
৫. অধ্যাপক আবুল খায়ের, ইতিহাস বিভাগ।

চাকরিচ্যুত হয়েছেন :
১. অধ্যাপক এ বি এম হাবিবুল্লাহ, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ।
২. অধ্যাপক এনামুল হক, প্রফেসর ইমেরিটাস।
৩. অধ্যাপক এম মনিরুজ্জামান, বাংলা বিভাগ।

যাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে :
১. অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ।
২. অধ্যাপক নিলীমা ইব্রাহিম, বাংলা বিভাগ।
৩. অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইংরেজি বিভাগ।
একাত্তরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাঙালিরা সীমিত সামর্থ্যে যে সব প্রকাশনা বিদেশিদের সামনে নিয়ে এসেছেন জনমত গঠনে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।