Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ ও শোকের মাস আগস্ট

আগস্ট মাস আসলেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি গভীর মনোযোগ দিয়ে, অধিকতর সম্মান দিয়ে, প্রাণভরা আবেগ দিয়ে, অন্তহীন ভালোবাসা দিয়ে এবং ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে যোগ্য সম্মান দিয়ে। তবে এ প্রবণতাও খুব বেশি দিনের নয়। কেননা এ কথা অনস্বীকার্য যে, ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ১৯৭১, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে জনপরিসরে যে পরিমাণ আলোচনা, গবেষণা, লেখালেখি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, একাডেমিক কার্যক্রম এবং বক্তৃতা-বিবৃতি হয়েছে, এর আগে কখনো সে মাত্রায় হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে তখনো এ প্রক্রিয়া একবার শুরু হয়েছিল; কিন্তু ২০০১ সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে যখন বিএনপি সরকার গঠন করে, পুনরায় সে প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ইতিহাসের বিকৃতি পুনরায় যাত্রা শুরু করে এবং বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্য চরিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আলোচনায় গৌণ হয়ে ওঠে আর একাত্তরের গৌণ চরিত্রগুলো মুখ্য হয়ে উঠে। ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে, তখন ইতিহাসের অগ্রযাত্রা নতুন করে সত্যের পথে যাত্রা শুরু করে। যেহেতু ২০০৮ সাল থেকে অদ্যাবধি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, সেহেতু স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক আলোচনা, গবেষণা এবং লেখালেখি নিয়মিতভাবে হয়েছে, যা ইতিহাসের বিকৃতি রোধের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতেও সহায়তা করেছে। এখানে যেটা মনে রাখা জরুরি সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা সম্প্রতি পালন করলেও বিগত ৫০ বছরের অধিকাংশ সময় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে তথা শাসন ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ছিল না। ফলে ইতিহাসের বিকৃতির চেষ্টাও কম হয়নি। ইতিহাস থেকে ইতিহাসের মূল চরিত্রগুলোকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ফলে ৫০ বছরের অধিকাংশ সময় বাংলাদেশ ইতিহাস বিরুদ্ধ স্রোতে অবগাহন করেছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষ এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় আসার পর ইতিহাসের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার পাশাপাশি বিরুদ্ধ স্রোতে ভেসে যাওয়ার বিকৃতির ঝাড়-মোছা করতে হয়েছে। ফলে ইতিহাস চলেছে দুই পা এগিয়ে আবার এক পা পিছিয়ে। এ কারণেই বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে ২০০৮ সালের আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা, গবেষণা এবং লেখালেখি যতটা হওয়ার কথা, ঠিক ততটা হয়নি। কিন্তু ২০০৮ সালের পর বঙ্গবন্ধুর জীবন, রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক দর্শন, অর্থনৈতিক দর্শন, পররাষ্ট্রনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির নানান বিষয় নিয়ে বিস্তার আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গবেষণা এবং লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু-চেয়ার’ স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিয়ে গবেষণা করার জন্য। বছরের শুরু থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানান অনুষ্ঠানাদি হয় যেখানে বঙ্গবন্ধুর জীবন, দর্শন এবং আদর্শ নিয়ে আলোচনা হয়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নতুন প্রজন্মের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম জানার সুযোগ পাচ্ছে একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু প্রভৃতি বিষয় নিয়ে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান শহীদ দিবস, ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্মরণে ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ’ উদযাপন, ১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, ২৫ মার্চের কালরাত্রি স্মরণ, ২৬ মার্চে মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস, ৭ জুনে ছয়দফা দিবস, ৮ আগস্টে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিবস, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার স্মরণে জাতীয় শোক দিবস, ২৫ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের (১৮৭৪ সালে) প্রথম বাংলা ভাষণ দেয়া স্মরণ, ১৮ অক্টোবরে শেখ রাসেলের জন্মদিন, ৩ নভেম্বরে জেলহত্যা দিবস, ১৪ ডিসেম্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বরে মহান বিজয় দিবস প্রভৃতি অনুষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হয়। এভাবে প্রায় বছরব্যাপী নানান মাত্রার প্রায় প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিস্তার আলোচনা হয়। কেননা ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয়দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতির আলোচনা, বিশ্লেষণ ও স্মৃতিকথন বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে হয় না। তাই বারবার প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ফিরে আসে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান, অবদান এবং সক্রিয় ভূমিকার কথা। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয় না, তেমনি বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের বিভিন্ন কালক্রমিক ইতিহাসও বঙ্গবন্ধু ছাড়া অর্থহীন। কেননা, ইতিহাসের নানান ঘটনা প্রবাহে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রধান চরিত্র। ফলে বঙ্গবন্ধু মানেই যেমন বাংলাদেশ, তেমনি বাংলার মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও মোটা দাগে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ইতিহাস। ইতিহাসের এ সত্যটুকু অন্তত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিগত ২০০৮ সাল থেকে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি ক্ষমতায় আসার কারণে।
কিন্তু শোকের মাস আগস্টে এসে বঙ্গবন্ধু স্মরণটা সবসময় বেদনাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কেননা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা স্মরণ করলে এখনো মনের গভীরে তীব্র যন্ত্রণা এবং কষ্টের মাতম ওঠে। ভারী হয়ে উঠে চতুর্দিক। আশপাশ সুনসান লাগে। ‘পরাণের গহিন ভিতরে’ হাহাকার জেগে ওঠে। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এদেশেরই কিছু মানুষ এভাবে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে পারে? যে বঙ্গবন্ধু নিজের গোটা জীবন এদেশের মানুষের জন্য, বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, বাংলার মানুষের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছেন; জেলে কাটিয়েছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর; পরিবার পরিজনকে বঞ্চিত করে এদেশের গরিব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য প্রাণপণ লড়াই করেছেন, সে বঙ্গবন্ধুকে এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যা করতে পারে? ইতিহাসের এ কলঙ্ক অমোচনীয়। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার করা হয়েছে, কিন্তু ইতিহাসের এ কালো অধ্যায় নিকষ কালো অন্ধকার হয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। প্রতি বছর আগস্ট মাস এসে আমাদের মনে করিয়ে দেবে, আমরাই সে অকৃতজ্ঞ জাতি, যাদের কিছু কুলাঙ্গার লোক জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। আগস্ট আমাদের বার্ষিক ইতিহাসের একটি কালো তিলক হয়ে প্রতি বছর আমাদের বিবেকের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। বঙ্গবন্ধু অমøান, অক্ষয়, অমলিন এবং অবিস্মরণীয়। কিন্তু আগস্ট আমাদের প্রতি বছর একবার এসে অপরাধবোধের জলাশয়ে ডুবিয়ে যায়। আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে যায় যে, আমরা এক অকৃতজ্ঞ জাতি, কারণ আমাদেরই কিছু লোক আমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। এ গøানি অন্তহীন!

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]