Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

দু’চাকায় দুনিয়া দেখা রামনাথ বিশ্বাস 

এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গ্রাম কোনটা বলতে পারেন? উত্তর বানিয়াচং। হবিগঞ্জ জেলার এই বিখ্যাত গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন দু’চাকায় দুনিয়া ঘুরে দেখা দেশের প্রথম ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস।

জন্ম ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি, বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণপাড়ায়। বাবা বিরজনাথ বিশ্বাস ও মা গুণময়ী দেবীর দুই সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। রামনাথের বড় ভাই কৃপানাথ বিশ্বাস এলাকায় চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতনামা ছিলেন। শৈশবেই মা-বাবাকে হারিয়ে এই ভাইয়ের সংসারেই বেড়ে ওঠেন রামনাথ।  

৭ জুলাই ১৯৩১। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। কুইন স্ট্রিটের বাঙালি মসজিদ থেকে রামনাথ যাত্রা শুরু করবেন। মাঝ সকালে সেখানে গিয়ে দেখেন উপচে পড়া ভিড়। আমজনতা এসেছে রামনাথকে শুভেচ্ছা জানাতে। ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে মুখরিত কুইন স্ট্রিট। ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিও সমানতালে উচ্চারিত হচ্ছে। সিলেটের মুসলমানরা জ্ঞাতি ভাইয়ের জন্য নিয়ে এসেছেন শত সহস্র শুভেচ্ছা ও আশীর্বাণী। রামনাথ মনে ভরসা নিলেন। গাঁটরির  মধ্যে নিলেন বিখ্যাত ব্যক্তিদের অটোগ্রাফ নেওয়ার খাতা, একটি খদ্দরের চাদর, একটি মশারি। সহস্র মানুষের উল্লাসের মধ্য দিয়ে রামনাথ সাইকেল চালিয়ে দিলেন পৃথিবীর পথে। 

তিনি গেলেন  কুয়ালালামপুর হয়ে থাইল্যান্ড, সেখান থেকে ইন্দোচীন। এখান থেকে হংকং, ক্যান্টন, নানকিন, সাংহাই হয়ে পিকিং। পিকিং থেকে কোরিয়া। সেখান থেকে বিরাট পথ পাড়ি দিলেন। আমেরিকা তাঁর অভীষ্ট। প্রথম লোহার গেট কানাডা। ঢুকতে হলে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা জমা দিতে হবে। সাইকেল যার বাহন সেই পর্যটকের পকেটে অত টাকা থাকে? রামনাথকে বন্দি করা হলো ভারকোডার  জেলখানায়। ২৯টি ভয়ঙ্কর দিন  রাত। একদিন দেয়ালে বড় বড় অঙ্ক দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন  অঙ্কবিদ সমরেশ বসুও একবার অর্থাভাবে এখানে আটকা পড়েছিলেন। এটি দেখে তিনি সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিলেন। কানাডা সরকার তাকে একটি জাপানি জাহাজে তুলে দিয়েছিল। ১২ দিন পরে নেমেছিলেন ইয়োকোহামা বন্দরে। এখানেও সেই হায় রাম অবস্থা। জাপান সরকার তাকে প্রবেশ অনুমতি দিলো না। ইংরেজকে তুষ্ট করতে কানাডা ও জাপান সরকার এই কাজ করেছিল। জাপান থেকে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো সাংহাইতে। সেখান থেকে তিনি গেলেন ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ার ওলন্দাজ সরকার তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। অমানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল তখন। চট্টগ্রামের এক বাঙালি জামিনে তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। তারপর রামনাথ গিয়েছিলেন বার্মা। এরপর ভারতবর্ষ।

১৯৩৪ সালের ১৫ জুনের অ্যাডভান্স পত্রিকা তাঁর এই বিশ্বভ্রমণ সম্পর্কে লিখল: ‘এখন পর্যন্ত ২৯ হাজার মাইল পথ ছুটে চলা এ যাত্রা মৃত্যুর সঙ্গে তার জুয়াখেলা ছাড়া আর কিছুমাত্র নয়।’

১৯৩৪ সালের জুলাইয়ে রামনাথ বিশ্বাসের সাইকেল আবার চলতে শুরু করে আফগানিস্তান, পারস্য, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন হয়ে তুরস্ক। কামাল পাশার দেশ গড়ার দৃঢ়তা দেখে আশা পেয়েছিলেন। তুরস্ক থেকে দুই চাকায় গেলেন বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভাকিয়া, হাঙ্গেরি, অস্টিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স। এ সময় তাঁর খোরাকি জোগাড় করেছে প্রবাসী ভারতবর্ষীয়রা। আরেকটি কাজ করতেন, রেস্তোরাঁয় বসে ভ্রমণকাহিনী বলতেন। মালিকের সঙ্গে চুক্তি আধঘণ্টা ১০ পাউন্ড। এভাবে টাকা যোগাড় করে তিনি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বিলেতেও গিয়েছিলেন। 

ব্রিটেন ও স্কটল্যান্ড বেড়াতে গিয়ে রামনাথের শরীর ভেঙে পড়ে। দেশে ফেরেন ১৯৩৬ সালে। সুস্থ হয়ে যান কবিগুরুর কাছে। বিশ্বকবি আশীর্বাণী দিয়েছিলেন – ‘উইথ মাই ব্লেসিংস টু দ্য ইনট্রেপিড অ্যাডভেঞ্চারার রামনাথ বিশ্বাস।’ এরপর ১৯৩৮ সালে তিনি আফ্রিকা মহাদেশে রওনা হয়েছিলেন। বম্বে থেকে জাহাজে মোম্বাসা পৌঁছান। তারপর দুই চাকা গড়িয়ে কেনিয়া, উগান্ডা, নয়াসাল্যন্ডসহ রোডেসিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভাল, লরেনসোমার্ক, নাটাল, ডারবান, ইত্যাদি ঘুরলেন। এরপর আবার চেষ্টা করলেন আমেরিকা যেতে, পেরেওছিলেন। মনে শক্তি থাকলে কিনা হয়? আমেরিকা গিয়ে তার বেশি ভালো লাগেনি। বর্ণবাদ আমেরিকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই আমেরিকা থেকে তিনি ১৯৪০ সালে দেশে ফিরে ইস্তফা দেন পর্যটনে। 

৩২টি বই লিখেছেন রামনাথ বিশ্বাস। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তরুণ তুর্কি, আজকের আমেরিকা, বেদুইনের দেশে, ভয়ঙ্কর  আফ্রিকা, জুজুৎসু জাপান, পারস্য ভ্রমণ, লাল চীন, মালয়েশিয়া ভ্রমণকাহিনী, ভারত ভ্রমণ ইত্যাদি। আজ যে চীন ১৯৪৯ সাল থেকে দাপটে নতুন রাজ্য গড়ে তুলেছে, সারা পৃথিবী যার দিকে পরম বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় তাকিয়ে আছে, তার সঙে বাঙলা সাহিত্যকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রামনাথ বিশ্বাস; তাঁর ‘মরণ বিজয়ী চীন’ এবং ‘লাল চীন’ নামে দুই বইয়ের মাধ্যমে। আর রামনাথকে নিয়ে বই লিখেছেন শ্যামসুন্দর বসু। বইয়ের নাম ‘রামনাথের পৃথিবী’। 

রামনাথ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে শ্যামসুন্দর বসু প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। কারণ তাঁর সম্পর্কে তথ্য ছিল  অপ্রতুল। মানুষ রামনাথ কেমন ছিলেন তা বলতে গিয়ে শ্যামসুন্দর বসু বলেছেন,  রামনাথ যেখানে গেছেন, সেখানেই স্বাক্ষর রেখে এসেছেন উন্নত মনুষ্যত্বের। পরকে করেছে আপন। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে শুধু সমবেদনা জানিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, দরকার মতো বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। অন্ত্যজ শ্রেণীর সঙ্গে  চলার সময় জ্ঞানী বা সবজান্তার ভূমিকা তিনি নিতেন না। তাদের মতো করেই অবলীলায় মিশে যেতেন। ফলে তারাও পর্যটকদের কাছে হৃদয়ের দরজা খুলে দিত। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আফ্রিকা যাত্রার আগে বলেছিলেন, ‘দেখো রামনাথ, নিগ্রো চরিত্রে যা ভালো দেখবে, তাই বয়ে নিয়ে আসবে।’ কিন্তু বঞ্চিত অত্যাচারিত নিগ্রোদের যন্ত্রণায় ব্যথিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘নিগ্রো চরিত্রে কি আর ভালো দেখব? মনিব থেকে গোলাম পর্যন্ত সবাই নির্যাতনে পরম উৎসুক।’ 

একবার পিকিং-এর পথে এক রিকশাওয়ালাকে মার খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেননি। সাইকেল থেকে নেমে তাঁর বাক্সে থাকা ওষুধপত্র বের করে চিকিৎসা সেবায় লেগে যান। এর থেকে তাঁর মানবীয় গুণাবলী সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। রামনাথকে এখনো খুব অল্প মানুষই চেনেন। কলকাতায় তাঁর নামে রয়েছে, ‘রামনাথ বিশ্বাস সড়ক’ অথচ নিজভূমে তিনি রয়ে গেছেন পরবাসী। 

তাঁর দীর্ঘ সাইকেল পরিভ্রমণের শেষ জীবন ভারতের কলকাতাতেই কেটেছে। ঘরকুনো বাঙালি কথার অপবাদ যিনি ঘুঁচিয়েছিলেন সেই রামনাথ বিশ্বাস মারা গিয়েছিলেন ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর।

রামনাথের মৃত্যুর ৫১ বছর পরে ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপানসন ফোরামের আমরা ২০জন বানিয়াচং গিয়েছিলাম। আমরা গিয়েছিলাম জলপথে। ফিরে এসে 'ভৈরব টু বানিয়াচং' শিরোনামে আমার একটি লেখাও ছাপা হয়েছিল তখন ‘দৈনিক সমকালে’। তখনি মূলত রামনাথ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানতে পারি এবং লেখালেখি শুরু করি। আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল রামনাথের দূর সম্পর্কের ভাতুষ্পুত্র শ্যামাপ্রসাদ বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি এখন আর বেঁচে নেই। রামনাথ সম্পর্কে তিনি আমাদের গল্প করেছিলেন, ‘ছোটদের তিনি খুব ভালোবাসতেন, বিকাল হলে খাকি প্যান্ট আর লিলেনের শার্ট পরে জেঠু ছোটদের নিয়ে মন্দিরে আসত। আমিও সঙ্গে এসেছি কয়েকবার। বেশি একটা মনে নেই, লজেন্স কিনে দিত। জাত-পাত মানতো না। যে কোনো বাড়িতে গিয়ে পাত পেড়ে বসে পড়তো। আর গল্প শুরু করলে থামতে চাইত না।'

তারপর আমরা রামনাথের বাড়ির দিকে গেলাম। ইটের একতলা বাড়ির সামনে পুকুর। ভিতরে ঢুকে আবিষ্কার করলাম রামনাথের বাড়ির পুরনো ভবনের লোহা কাঠ খোদাই করে ইংরেজিতে লেখা Ramnath Biswas: 1898. কে লিখেছে আমরা জানি না। রামনাথ সম্পর্কে তখন পর্যন্ত বানিয়াচং-এর ৮০ ভাগ মানুষেরই কোনো ধারণা ছিল না। এত দিনে হয়তো তারা জেনেছেন রামনাথ বিশ্বাসের এত গুণের কথা। 

আবার ১৬ বছর পরে বানিয়াচং যাচ্ছি তাঁর বাড়ি পুনরুদ্ধারের দাবিতে। কারণ রামনাথের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি একটি প্রভাবশালী পরিবার দখল করে আছে। আশাকরি সকলের ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল আমাদের সাথে একাত্ম  হবেন । আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যটন দিবস উপলক্ষে আমরা সাইকেল রেলি করে রামনাথের বাড়ি যাব। আশাকরি আমাদের আশা সফল হবে।

লেখক: কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ট্র্যাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন