Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

কর আহরণ ও প্রদান : বিবেচনার কয়েকটি বিষয়

নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের আওতায় কর আরোপ আর রাষ্ট্রকে সেই কর পরিশোধের বিষয়টি এ নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় কর আদায় শব্দটা ততটা যুৎসই নয়, যতটা ভূমি কর বা খাজনার ক্ষেত্রে খাটে। আয়করের দর্শন হলো রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি আয় বা সম্পদ অর্জিত হলে রাষ্ট্র তার একটা নির্দিষ্ট অংশ ‘সমাজে সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা বিধান এবং আয় উপার্জনের পরিবেশ সৃজন তথা অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ আয় উপার্জনের পরিমাণ ভেদে একটা হিস্যা’ প্রাপ্য হিসেবে চাইতে পারে। ভূমি করের ক্ষেত্রে আগে রাষ্ট্র ভূমি বরাদ্দ দেয় এবং তার ভিত্তিতে খাজনা দাবি করে এখানে লেনদেন প্রকাশ্য, সুতরাং দাবি বা আদায়ের যৌক্তিকতা সেভাবে আসে। কিন্তু আয়করের ক্ষেত্রে লেনদেন অপ্রকাশ্য, রাষ্ট্র সৃজিত সুযোগ-সুবিধা সবাই ভোগ করলেও সবাই আয় বা সম্পদ অর্জন করতে পারে না। নিজের মেধা, বুদ্ধি, পরিশ্রম প্রয়োগ করে সম্পদ অর্জন করতে হয়। অতএব সেই আয়ের ওপর রাষ্ট্রের যে দাবি তা নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে প্রদেয়। এখানে রাষ্ট্রের পক্ষে তা ‘আদায়ের’ যৌক্তিকতা অনেকটা গৌণ।
আয়কর দেয়ার মতো আয় যে নাগরিকের আছে তিনি রাষ্ট্রকে দেয় কর পরিশোধ করবেন স্বেচ্ছায়, আইনগত বাধ্যতাধকতা পালন করে, নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। তবে হ্যাঁ যদি তিনি তা পরিশোধে গড়িমসি করেন, এড়িয়ে চলেন, অসাধু পন্থা অবলম্বন করেন তাহলে আইনের আওতায় রাষ্ট্রের প্রাপ্য উদ্ধারে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কেননা কেউ কর ফাঁকি দিলে তা উদ্ধারে ব্যর্থতার দায়ভার আহরণকারীর এ জন্য যে তাদের এ অপারগতায় সমাজে ন্যায়-অন্যায় বৈধ-অবৈধ অসম অবস্থানে চলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে তো বটেই, সমাজে সম্পদের অর্জন বণ্টনে বৈষম্য সৃজিত হতে পারে, এর ফলে সমাজ ও অর্থনীতিতে ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। এ নিরিখেই সব করদাতার সঙ্গে ‘আদায়’জনিত মনোভাব পোষণ বা ক্ষমতার প্রয়োগ বা সে ধরনের পরিবেশ সৃজন যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। সীমারেখা মেনে চলা জরুরি এ জন্য যে তা না হলে কর আরোপ, আহরণ, প্রদান ও পরিশোধের ক্ষেত্রে ভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতি উদ্ভব হতে পারে, করারোপ ও আহরণকারীর সঙ্গে করদাতার সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে, আস্থায় চিড় ধরতে পারে, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার, জোর-জবরদস্তির, পক্ষপাতিত্বের, আতাতের মতো অনেক কিছুই ঘটতে পারে। স্বচ্ছতার স্থলে অস্বচ্ছতার অনুপ্রবেশে কর আহরণের মতো রাজস্ব আয়ের দেহে সিস্টেম লস বা ইনফর্মাল রেভিনিউরূপী ‘সুগারের’ মাত্রা বেড়ে অর্থনীতি ‘ডায়াবেটিসে’ আক্রান্ত হতে পারে, ‘সাইলেন্ট কিলার’ নামে পরিচিত যে রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক।
এবারের জাতীয় আয়কর দিবস উদযাপনকালে এটা জানা বেশ প্রশান্তি প্রদায়ক যে সরকারের অন্যান্য খাতের বা ক্ষেত্রের চেয়ে রাজস্ব, বিশেষ করে আয়কর আহরণে অগ্রগতি অব্যাহত আছে, উৎসাহ ব্যঞ্জকভাবেই। আনন্দদায়ক যে আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি তথা করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃজনে পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়াসের ফসল থেকে এ সাফল্য আসছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে অর্থনীতিতে কর জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বাঞ্ছিত পরিমাণ আয়কর আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে স্বয়ম্ভরের গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর বিভাগের প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাসের, সহযোগিতা সঞ্জাত মনোভঙ্গি ভজনের, পদ্ধতি সহজীকরণের, করদাতার আস্থা অর্জনের অয়োময় প্রত্যয়। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি এনবিআরকে। গত চার অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয়কর রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকায় এসেছে।
নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি পুরনো উদ্যোগের সালতামামি বা ফলোআপ আবশ্যক হবে। ২০০৬-০৭ সালে এবং বছর কয়েক আগে জমকালো জরিপের মাধ্যমে যে লক্ষাধিক করদাতা শামিল হয়েছিলেন করদাতার মিছিলে, তারা কি আছেন? ২০০৭-০৮ কিংবা ২০০৮-০৯-এ যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করদাতা হয়েছিলেন তাদের খবর কী? দেশে যে ৯ লক্ষাধিক ক্রেডিট কার্ডধারী আছেন, আছেন প্রায় সমসংখ্যক গাড়ি-বাড়ির মালিক তাদের কাছে যাওয়ার সর্বশেষ অবস্থা কী? ইটিআইএন ব্যবহারকারীদের করজালে ঢোকানোর পথে প্রতিবন্ধকতাগুলোর দিকে নজর দেয়ার সময় ফুরিয়ে যায়নি। আয়কর দাতা যাতে নিজেই রিটার্ন ফরম পূরণ করতে পারে সে ব্যাপারে যে সহায়ক নির্দেশিকা প্রকাশ হয়েছিল, প্রচার হয়েছিল সিটিজেন চার্টার তা কি গণঅবিহিতির অবয়বে আছে এখনো। আগেও যেসব কর তথ্যকেন্দ্র, সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছিল প্রকল্পের প্রেরণায় সেগুলোর কার্যকারিতা থেমে গেছে কিনা তা দেখার অবকাশ রয়েছে। একই কার্যক্রম বারবার ‘নতুন’ করে চালু করলে ভিন্ন বার্তা পৌঁছাতে পারে টার্গেট গ্রুপের কাছে। কর মেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড় প্রমাণ করে করদাতাদের আগ্রহ বাড়ছে, অনেকেই ঝামেলামুক্ত উপায়ে বা পরিবেশে কর দিতে চান, কর দেয়াকে দায়িত্ব মনে করছেন, তাদের এই আগ্রহকে ধরে রাখতে হবে, তাদের উদ্বোধিত দায়িত্ববোধের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, তাদের আগ্রহকে সমীহ করতে হবে। করদাতাদের উদ্বুদ্ধকরণে প্রচার-প্রচারণার কাজে আগে তেমন কোনো বরাদ্দ ছিল না, কর আহরণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে অতীতে বর্তমানের মতো প্রযতœ প্রদানের নজির ছিল না, এখন এসব সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশটি নতুন মলাটে আইন হিসেবে প্রমিতকরণের কাজ শেষ পর্যায়ে। রাজস্ব আইনের সংস্কারের এ আয়োজন-উদ্যোগ সহসা সচকিত নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে পরিকল্পনা আর প্রাজ্ঞ পরামর্শকদের প্রয়াস পারঙ্গমতা। রাজস্ব আইন সংস্কারের সব উদ্যোগের আগ্রহ অভিপ্রায়ে কোনো কমতি নেই, কিন্তু বিদ্যমান আইনে ‘শতেক শতাব্দী ধরে নামা শিরে অসম্মানভারের’ লাঘব প্রকৃত প্রস্তাবে ঘটছে কিনা, সংস্কারকৃত আইন কতটা বাস্তবায়ন সম্মত, আয়কর আহরণকারী এবং দাতার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এর প্রয়োজনীয়তা এবং তার রূপকল্প ও তাৎপর্য তুলে ধরতেই এবারের আয়কর দিবসের প্রাক্কালে এই ভাবনা। প্রসঙ্গত, এ বছর ২০২২ সালে ১৯২২ সালের ভারতীয় আয়কর আইনের শতবর্ষ, যে আইনটি বেনামে এখনো বাংলাদেশে অনুসৃত হচ্ছে। ১০০ বছরের আয়কর আইনের কাছে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান কষতে এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে আয়কর আইনের সংস্কারের রূপরেখা সুপারিশ করতে ব্যবসায়ীদের চিন্তা চৌবাচ্চা (থিংক ট্যাংক) ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ গত ২৬ নভেম্বর একটি বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে সর্বাগ্রে উঠে আসে শতবর্ষী ১৯২২ সালের আয়কর আইন, যার প্রথম ৫০ বছর ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-ভারত এবং পাকিস্তান আমলে আর পরের ৫০ বছর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে, সেখানে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষিতই শুধু থাকেনি, দিনে দিনে তা আরো জটিল হয়েছে। আমরা জানি যে চিন্তা থেকে যেমন কাজের উৎপত্তি, আইনের প্রয়োগ তেমনি আইনের দৃষ্টিভঙ্গি ভেদে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। যারা আইন তৈরি করেন তাদের সঙ্গে যাদের ওপর এটির প্রয়োগ হবে তাদের মধ্যকার সম্পর্কেরও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে আইনের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে। এখানে তৃতীয় আরেক শরিকের কথাও এসে যায়, যাদের মাধ্যমে আইনটির প্রয়োগ হবে, তাদের মনোভাব, মনোভঙ্গি সক্ষমতা অক্ষমতার ব্যাপারটিও বিশেষভাবে বিবেচ্য থেকে যায় আইনের প্রয়োগ তথা বাস্তবায়নযোগ্যতার ক্ষেত্রে। কেননা আইন প্রয়োগের দায়িত্ব আইন প্রণেতার নয়, নির্বাহী বিভাগের। আইন পরিষদ যদি মনে করে এ আইন অন্যের জন্য, পরিষদ সদস্যদের ওপর সব সময় বা সমভাবে বর্তাবে না এবং নির্বাহী বিভাগও যদি ভাবে এ আইন নিজের ওপর ততটা নয় যতটা অন্যের ওপর প্রয়োগের জন্যই, তাহলে যাদের ওপর আইনের প্রয়োগ তারা হয়ে পড়েন প্রতিপক্ষ আইন প্রণেতা ও প্রয়োগকারীর। এই প্রতিপক্ষতার পরিবেশেই আইনের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যায় নিবর্তনমূলক, প্রতিরোধাত্মক। এই প্রেক্ষাপটে আইন উপেক্ষার, অমান্যের ও অগ্রাহ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। আইন মানুষের জন্য, মানুষ আইনের জন্য নয়, মানুষের কল্যাণেই আইনের প্রয়োজন। মানুষ আগে, আইন পরে। আইন মানুষকে মুক্তির জন্য, তাকে বন্দি বা বিব্রত করার জন্য নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার আইনের আওতায় স্বীকৃত, নিশ্চিত, নির্ধারিত, নিবন্ধিত হয়ে থাকে। মানুষ তার চিন্তার, বিশ্বাসের, শরীরের, দেহের, চলাচলের, সম্মানের ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও নিরাপত্তা দাবি করতে পারে আইনের কাছে। আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সর্বজনীন এবং প্রয়োগে নিরপেক্ষ হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। যে আইন যত সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বজনমান্য, সর্বজনবোধ্য, সর্বজন অনুসৃতব্য সে আইন তত কল্যাণকর, সে আইন তত কার্যকর।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য।
[email protected]