Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

মিত্রবাহিনী গঠন, ভারতে পাকিস্তানের আক্রমণ

স্বচ্ছ নীল আকাশে মিগ ডাইভ দিচ্ছে। ওড়াউড়ি করছে ডগফাইটও। নিচ থেকে ছোড়া কামানের গোলার সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশ। ভূপাতিত হয়েছে কয়েকটি ভারতীয় উড়োজাহাজ। তখনো রাত ৮টা বাজেনি। রণক্ষেত্র ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের এলিভেটরে উঠতে যাচ্ছেন দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এশিয়ার সাংবাদিক (পরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এশিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক) পিটার কান। ওই সময় অন্য একজন রিপোর্টার এসে জানালেন, ‘জানেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’ একাত্তরের ঘটনাগুলো তখন নিয়মিত ডায়েরিতে লিখে রাখতেন পিটার কান। তার ওই ‘ঢাকা ডায়েরি’ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ১৪ ডিসেম্বর ’৭১ থেকে। পরে ওই লেখা তাকে এনে দেয় পুলিৎজার পুরস্কার।

পিটার কান লেখেন, স্পষ্টত আজ অপরাহ্ণে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধ লেগে গেছে। ভারত বলেছে পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করেছে, পাকিস্তান বলেছে ভারত। কে জানে? তবে দশ দিন ধরে ভারত পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সীমিত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর ছিল শুক্রবার। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী যে অত্যাচার করেছে, শরণার্থীরা কেন ভারতে আসছে তার কারণ অনুসন্ধান কেউ করেনি, করতে চায়নি। বিদেশিদের কাছে বারবার সব বলা হয়েছে, কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে আসেনি। আমরা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এভাবে মরতে দিতে পারি না, আমরা মরতে দেব না। ভারতের পঞ্চান্ন কোটি মানুষের পূর্ণ সাহায্য বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে থাকবে। এদিকে সমাবেশ চলাকালে মঞ্চের মধ্যেই জরুরি খবর আসে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে। ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে রাজধানী নয়াদিল্লিতে চলে যান। ভারতীয় সময় রাত বারোটা কুড়ি মিনিটে জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান আজ ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। ভারতকে এ যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে। পাকিস্তানের আক্রমণ ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিহত করতে হবে। দেশবাসীকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

মূলত বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে পরিণত করার মতো শেষ অস্ত্র বেছে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তারা আকস্মিকভাবে স্থল ও আকাশপথে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল আক্রমণ করায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, যোধপুর, আম্বালা ও আগ্রা বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় পাকিস্তান। মধ্যরাতে ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের কথা তুলে ধরেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম।

মিত্রবাহিনী গঠন: এদিন পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের ফলে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডার লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড।

ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী। ওইদিন গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে পূর্ব সীমান্তে অভিযান শুরু করে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাক অবস্থানকে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টায় সীমান্তের ৭টি এলাকা দিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্য, ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধারা মুখোমুখি হয়। ভারত যে কোনো মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে- এ খবর ছড়িয়ে পড়ে মুজিবনগর, কলকাতা ও দিল্লিতে।

সাবমেরিন গাজীকে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয় মিত্রবাহিনী: মুক্তিযোদ্ধাদের অনবরত হামলায় পাকিস্তানি হানাদাররা তখন দিশেহারা। মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশন যশোর-ঢাকা মহাসড়কসহ চতুর্থ ডিভিশন ষষ্ঠ ডিভিশনের বেশ কয়েকটি এলাকায় যোগাযোগ পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর জেলার আরো কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী পাক অধিকৃত বন্দর অবরোধ করে জলপথে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। আক্রমণের প্রথমেই পাকিস্তানি বাহিনীর সাবমেরিন গাজীকে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয় মিত্রবাহিনী। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি করে সামরিক কর্তৃপক্ষ। এদিন দুপুর ১২টার দিকে বরগুনা শত্রæমুক্ত হয়। শত্রæমুক্ত স›দ্বীপে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার শমশেরনগরও মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট কিলো ফ্লাইটের সদস্যরা ভারতের কৈলাস বিমানঘাঁটি থেকে বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করে সফল অভিযান চালান। রাত ২টায় ৩০০ ফুট উঁচুতে উড়ে শামসুল আলম (বীরউত্তম) ও আকরাম আহমদের (বীরউত্তম) নেতৃত্বে একটি বিমান চট্টগ্রাম তেলের ডিপো ধ্বংস করে দেয়। আবার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে সফল আঘাত হানে সুলতান মাহমুদ (বীরউত্তম) ও বদরুল আলমের (বীরউত্তম) নেতৃত্বে একটি হেলিকপ্টার।

যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়ার সিদ্ধান্ত সোভিয়েতের: পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দেয়- বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যে কোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তারা ভেটো দেবে। অন্যদিকে প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে ২৮ বছর বয়সী জঁ ক্যা নামে এক ফরাসি যুবক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ‘সিটি অব কুমিল্লা’ নামের বোয়িং-৭২০ যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেন। প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে এটির করাচি যাওয়ার কথা ছিল। পাইলট বিমান চালু করতেই জঁ ক্যা পিস্তল বের করে ইঞ্জিন বন্ধের নির্দেশ দিয়ে বলেন, নির্দেশ না মানলে বোমা দিয়ে বিমান উড়িয়ে দেয়া হবে। এরপর বাংলাদেশের যুদ্ধরত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের জন্য বিমানটিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী তুলে দিতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন তিনি।

ডি- এইচএ