Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কৌশলে কমানো হয়েছে

কিছুদিন আগে কিছু পত্রিকার খবরে দেখলাম খুব সুন্দর করে লিখেছে ‘সঞ্চয়পত্রের বাজারে ধস’। এটা আসলে ধস নয়। আমরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগসীমা কমিয়ে দিয়েছি যেন মানুষ সেই টাকাটা নিয়ে পুঁজিবাজারে আসেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

সোমবার (৩ অক্টোবর) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের হল রুমে আয়োজিত ‘বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহ-২০২২’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সপ্তাহব্যাপী এ আয়োজনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মত কোনো গভর্নরের বিএসইসি কার্যালয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলো।

বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

গভর্নর বলেন, আপনারা অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা কী হওয়া উচিত। এটা আলোচনা করার কোনো বিষয় না। একটা রেগুলেটর হিসেবে আমাদের কাজই হবে ক্যাপিটাল মার্কেটকে সহায়তা করা। সে কাজটা আমরা করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের সব থেকে বড় সমস্যা নন পারফরমিং লোন (খেলাপি ঋণ)। নন পারফরমিং লোন হওয়ার অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে মূল কারণ ব্যাংকগুলো শর্ট টার্ম ডিপোজিট নিয়ে লং টার্ম ইনভেস্ট করে। সুতরাং এখানে একটা মিসম্যাচ আছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা যদি পার্শ্ববর্তী দেশের দিকে তাকাই, খুব বড় দেশের দিকে যাওয়ার দরকার নেই, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার- এখানে আমরা দেখতে পাই একজন উদ্যোক্তা তার পুঁজি তোলেন ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে, যেটাকে বলে টার্ম লোন এবং তিনি ব্যাংক থেকে নেন ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল। আমাদের এখানে যেটা হয়েছে, উদ্যোক্তারা লোন নেন ব্যাংক থেকে, টার্ম লোন, ওয়ার্কিং ক্যাপিটালও এখান থেকে নেন।

আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, বন্ড মার্কেটে যে কুপন বা ইন্টারেস্ট দেয় তা বছর শেষে একবার। কিন্তু যিনি ব্যাংক থেকে লোন নেন তাকে প্রতি কোয়ার্টারে টাকা দিতে হয়। অনেক জায়গায় ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো মাসে মাসেও চার্জ করে। এখন ক্যাশফ্লোর একটা ব্যাপার আছে, ব্যবসার একটা ব্যাপার আছে। কোনো কিছুর কেয়ার করা হয় না। যদি উনি পরপর দুটি কোয়ার্টার মিস করেন, ডিফল্টার হয়ে যাচ্ছেন। এভাবে আমাদের ডিফল্টারের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, আমরা যদি বন্ড মার্কেটকে ভালো করতে পারি, তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা বন্ড মার্কেটে যাবেন। সেখান থেকে টাকা তুলবেন এবং ব্যাংক থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল নিয়ে তিনি ব্যবসা করবেন।

গভর্নর বলেন, আমাদের কিছু ব্যাংক টিআর-২ বন্ড ইস্যু করছে। আমি যোগ দেওয়ার আগে একটা ট্রেন্ড ছিল, এক ব্যাংক বন্ড ইস্যু করে অন্য ব্যাংক কিনে নেয়। এটা বাইরে ছিল না। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদানের পর এটা ৫০ শতাংশ করে দিয়েছি। এখন ৫০ শতাংশ বাইরে বিক্রি করতে হবে।

তিনি বলেন, ব্যাংকের যে বন্ড তা সব থেকে নিরাপদ বন্ড। কারণ বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যাংক ফেল করেনি। আমি মনে করি আগামী ৫০ বছরেও কোনো ব্যাংক ফেল করবে না। আমি যোগ দেওয়ার পর পাঁচ-ছয়টা ব্যাংক এসেছে, সবগুলোকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি ৫০ শতাংশ বাইরে বিক্রি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সরকারি ট্রেজারি বন্ড এবং বিল আছে, এগুলোকে সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন করার জন্য একটা অটোমেটিক সিস্টেম এরই মধ্যে তৈরি করা হয়ে গেছে। এটার মক ট্রায়াল হয়েছে, আমরা দেখেছি খুব ভালো কাজ করছে। সরকারের কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি আছে, মনে হয় ১-২ সপ্তাহ লাগবে। তবে আমার মনে হয় এটা আমরা ট্রায়াল হিসেবে শুরু করতে পারি আগামী সপ্তাহ থেকে। এটা করতে পারলে বন্ড মার্কেট আরও ভাইব্রেন্ড হবে।

গভর্নর বলেন, বন্ড মার্কেটের বিকাশের আরেকটা বড় সমস্যা ছিল সঞ্চয়পত্র। সঞ্চয়পত্রের হাই ইন্টারেস্ট রেট ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্যাপ ছিল না। যদিও বলা থাকতো ৫০ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না। যিনি কিনলেন তিনি এক ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনলেন, আবার আরেক ব্যাংকে গিয়ে ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র কিনে নিলেন। তিনি স্টেটমেন্টও দিচ্ছেন এই ৫০ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র নেই। আমরা এমন লোক দেখছি যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে, তাদের বাসা থেকে ১৪৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র উদ্ধার হয়েছে।

তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের যে হাই ইন্টারেস্ট আমরা কিন্তু জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেই। সবার ট্যাক্সের টাকা দিয়ে এই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের আমরা ইন্টারেস্ট দিচ্ছি। সুতরাং গরিব মানুষের ট্যাক্সের টাকা নিয়ে আমরা বড়লোকদের ফাইন্যান্স করছি। আমি অর্থ সচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম যে কাজটা করি, এটা অটোমেশন করা। অটোমেশনের উদ্দেশ্য ছিল আগে ক্যাপ এনসিউর করা। একজন লোক যেন ৫০ লাখের বেশি কিনতে না পারে। সেটা আমরা করে ফেলেছি। এখন কেউ ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না।

গভর্নর বলেন, দ্বিতীয় হলো সঞ্চয়পত্রের ইন্টারেস্ট রেট অনেক কমানো, কিন্তু আমাদের পলিটিশিয়ান যারা তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি বোঝেন, তারা আমাদের বললেন এটার মধ্যে একটা সেফটিনেট এলিমেন্ট আছে। যেটা আমরা ইগনোর করে গিয়েছিলাম। কিছু লোক কোনোভাবে সঞ্চয়পত্র জোগাড় করে, তার ওপর ডিপেন্ড করে বিশেষ করে বয়স্ক লোক। তখন আমাদের পরামর্শ দেওয়া হলো, একটা সময় পর্যন্ত ইন্টারেস্ট রেট ঠিক রেখে তারপর কমিয়ে আনা।

‘আমরা সেটাই করেছি। ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ইন্টারেস্ট ঠিক রেখে, এরপর এক শতাংশ, তারপর এক শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে এবং সেখানে আরও ১০ শতাংশ ট্যাক্স আছে। যেটা হয়েছে, এখন সঞ্চয়পত্র ততটা অ্যাট্রাকটিভ (আকর্ষণীয়) না। বরং আপনি যদি বন্ড মার্কেটে যান, এটা সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে কম্পিটিশন করতে পারবে। এটা করতে আমাদের চার বছর লেগেছে।’ যোগ করেন আব্দুর রউফ তালুকদার।

তিনি বলেন, আমরা পত্রিকায় দেখলাম সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস, আসলে ধস নামেনি, আমরা বিক্রি কমিয়ে দিয়েছি। এখন অন্যভাবে রিপোর্ট করা হচ্ছে, এটা ধস না। আমরা চাই মানুষ টাকা নিয়ে ক্যাপিটাল মার্কেটে আসুক। সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ না করে ক্যাপিটাল মার্কেটে আসুক, যাতে উদ্যোক্তারা এই টাকা নিয়ে ইনভেস্ট করতে পারেন। আর সঞ্চয়পত্র যেহেতু উচ্চ ইন্টারেস্ট রেট, সরকার অন্য জায়গা থেকে কিন্তু কম ইন্টারেস্টে টাকা সংগ্রহ করতে পারে।

অনুষ্ঠানে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে ১৯৯৬ আর ২০১০ সাল আর কখনই ফিরে আসবে না। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সবাই একসঙ্গে কাজ করে আমরা যদি অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তবে দেশ উপকৃত হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ অন্যানের মধ্যে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন এবং বিশেষ করে সরকারি বন্ড সহ কর্পোরেট বন্ড মার্কেটের উন্নয়নের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, “উন্নত দেশগুলোতে বন্ড মার্কেটই বড় কিন্তু আমাদের এখানে বন্ড মার্কেটের আকার তেমনটি নয়। আমাদের দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ, আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করছি। আমাদের এই উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে শক্তিশালী পুঁজিবাজারের উপযোগিতা রয়েছে। পুঁজিবাজারের উন্নতি পথে বিদ্যমান সমস্যা গুলো খুজে বের করে সেসব সমাধানে আমাদের কাজ করতে হবে।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে বিএসইসি কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে নিরাপদ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এজন্য বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণ, কর্মশালাসহ বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও উদ্যোগ নিয়েছি। বিনিয়োগ শিক্ষাকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তকরণের মাধ্যমে বিনিয়োগ শিক্ষাকে আমরা সবার দোরগোড়ায় পেীছে দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি।
ফেয়ার কানাডার নির্বাহী পরিচালক জিয়ান পল বুরেইদ ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগদান করে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

এছাড়াও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কমিশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমানের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন কমিশনের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, বিএমবিএ এর প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান, ডিবিএ এর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি’ রোজারিও এবং বিএপিএলসি এর সেক্রেটারি জেনারেল মো. আমজাদ হোসেন।

এমকে