Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

কোভিড মহামারির কারণে শিশুশ্রম আরও বেড়েছে

দেশের আইন অনুযায়ী ১৪ বছর বয়সের কম বয়সি কোনো শিশুকে নিয়মিত কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে না। অপরদিকে ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োগের বিষয়টিও আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। দেশে এখন কত সংখ্যক শিশুশ্রমে এবং ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত এ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্যও মিলে না। কারণ ২০১৩ সালের পর দেশে শিশুশ্রম নিরসনে কোনো জরিপ হয়নি। হালনাগাদ তথ্য না থাকায় কাজের গতিও শ্লথ। তবে আশার কথা হচ্ছে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন জরিপ করছে। এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের সময়সীমা কয়েক দফা পিছিয়েছে সরকার।

২০১০ সালে শিশুশ্রম নিরসনে সরকার একটি নীতিমালা করে। ওই নীতিমালার আলোকে ২০১২ সালে কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই কর্মপরিকল্পনাতে ২০১৬ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে লক্ষ্য পূরণ না হলে তা ‘রিভাইজ’ করা হয় ২০২১ সালকে লক্ষ্য ধরে। সেটিও সম্ভব না হলে নতুন করে ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করছে। এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত প্রায় সাড়ে ৮ কোটি শিশু। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জাতীয় শিশু জরিপ-২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত আছে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেশের ১৩ লাখ শিশু। বর্তমানে এই সংখ্যাটা আরো অনকে বেশি। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে- যা প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ। এরপরেই চট্টগ্রামে রয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম শিশু শ্রমিক বরিশালে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

এদিকে কোভিড-১৯ মহামারির পর শ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা যে আরো বেড়েছে সেটিও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে এডুকেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এডুকো) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিশুশ্রম বেড়ে ৮৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। করোনাপরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রায় ৫৬ শতাংশ শিশু শ্রমিক সংসারে বাবা-মাকে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন কাজ করেছে। পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা কাটাতে না পারায় ৪৬ শতাংশ শিশু শ্রমিক স্কুলে ফেরেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যে সব রকম শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের সময়সীমা বারবার বাড়ানো, করোনাপরবর্তী সময়ে সবধরনের শ্রমে এবং ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে চ্যালেঞ্জ বাড়িয়েছে। তাই ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- যা পূরণে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও সমন্বয় করে সম্মিলিতভাবে কাজ করার পক্ষে জোর দেন তারা।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে সরকার জোর দিয়েছে কারিগরি শিক্ষা এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর। শিশুশ্রম নিরসনে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।

জানা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুকে শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহারে ৬ মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং ৪ মাসের প্রশিক্ষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ শিশুরা প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে উপবৃত্তি পাবে। উপবৃত্তির এ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে দেয়া হবে। এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে শুধু এই এক লাখ শিশুকে প্রত্যাহারই নয় এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করা হবে।

শ্রম ও কর্ম সংস্থান বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক চুন্নু সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কাজের ধীর গতির জন্য বন্ধ হচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। ২০১৮ সালে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়- যা বাস্তবায়নের কাজ কেবল শুরু হয়েছে। কাজটি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে গত ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় শিশুশ্রম নিরসনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেছেন, দেশের বেকার জনসংখ্যার জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ কর্মসংস্থান সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরির জন্য ‘কর্মসংস্থান অধিদপ্তর’ গঠনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শিশুশ্রম নির্মূল এবং নারী শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের কার্যক্রম আরো বেগবান করা হবে। ৮ জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় শিশুশ্রম নিরসনবিষয়ক এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এহছানে এলাহী জানান, শিশুশ্রম নিরসন প্রক্রিয়া জোরদারকরণ এবং শিশুশ্রম নিরসনের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শিশুশ্রম নিরসন বিষয়ক শাখাকে ইউনিটে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

জানা যায়, শিশুশ্রম নির্মূল সংক্রান্ত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ইউনিসেফের সঙ্গে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। কর্মজীবী শিশুদের প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জাতীয় শিশুশ্রম নির্মূল নীতি-২০১০ হালনাগাদের কাজ চলমান রয়েছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার সব সেক্টর থেকে শিশুশ্রম নির্মূলের জন্য দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা (২০২২-২০২৩) তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও, সারাদেশের সব সেক্টর থেকে শিশুশ্রম নির্মূলের জন্য এক বছরের (২০২২) কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে আজ ১২ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করি; শিশুশ্রম বন্ধ করি’। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১৯৯২ সালে প্রথম দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়।

রি-এসডি/ইভূ