Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

মানবজীবনে যুদ্ধের ভয়াবহতা

যুদ্ধ হচ্ছে রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং যে কোনো ধরনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তীব্র সশস্ত্র সংঘর্ষ। একটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজমান হয়। লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি, বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। চারদিকে মানুষের চিৎকার ও ধ্বংসস্তূপের হাহাকার, অজস্র লাশ থাকে পড়ে। একটি দেশকে সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। যুদ্ধ শুধু যে দুটি দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে বা দুটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এমন নয়। একটি দেশ যখন অন্য একটি দেশকে আক্রমণ করে তখন ওই দুই দেশের মিত্র দেশগুলোও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী, অস্ত্র, খাদ্য, ওষুধপত্র ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সহযোগিতা করে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সর্বাত্মকভাবে শুরু হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত চলমান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু যে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে এমন নয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, উত্তর কোরিয়া কানাডা, ফ্রান্স অর্থাৎ বিশ্বের বড় বড় শক্তিশালী দেশগুলো এতে জড়িত ছিল। ইউক্রেন হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গম উৎপাদনকারী দেশ। এজন্য ইউক্রেনকে ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয়। ইউক্রেন সাধারণত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক দেশ, যা বিশ্বের ৪২ শতাংশ সূর্যমুখী তেল, ১৬ শতাংশ ভুট্টা এবং ৯ শতাংশ গম উৎপাদন করে। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক জানিয়েছে আফ্রিকায় প্রয়োজনীয় গমের ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে প্রায় ৩ কোটি টনের খাদ্যের ঘাটতি তৈরি হয়েছিল আফ্রিকায়। যার ফলস্বরূপ আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে খাদ্যের দাম বেড়েছিল ৪০ শতাংশ। একইভাবে ইয়েমেন প্রতি বছর ১০ লাখ টনেরও বেশি গম আমদানি করে ইউক্রেন থেকে।
সুতরাং আমরা দেখতে পারতেছি, শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলেই সম্পূর্ণ আফ্রিকা মহাদেশ ও ইয়েমেনসহ বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। যার ফলস্বরূপ খাদ্য সংরক্ষণাঘারে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য শস্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করতে না পারায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যশস্য সংরক্ষণাগারে নেই। শুধু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নয়। আমরা যদি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নজর দেই, তাহলে দেখতে পাই যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আনুমানিক ১ কোটি সামরিক মৃত্যু ও ৭০ লাখ বেসামরিক মৃত্যু এবং আহত প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনুমানিক ৭ কোটি সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ‘ফ্যাটম্যান’ নিক্ষেপ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেরি এস ট্রুম্যান এই বোমা ফেলার নির্দেশ দেন। এজন্য এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে।
জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলার পরবর্তীকালে এর তেজস্ক্রিয়তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে আরো ২ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ যুদ্ধের পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে তা আমাদের চিন্তা জগতের বাইরে। যুদ্ধের পরে শুধু হাহাকার আর রিক্ততা দেখতে পাওয়া যায়। যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে ওই মাটিতে ফসল হয় না, বছরের পর বছর লেগে যায় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেতে। বোমা ও বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করার কারণে অত্র এলাকায় প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা ও বিভিন্ন রোগ বা মহামারি সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পরে যুদ্ধবিরতি, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবতার কল্যাণের লক্ষ্যে ১১টি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ গঠিত হয়। জাতিসংঘের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষা, জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখা, জাতিসমূহকে তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তাকল্পে একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করা ইত্যাদি। জাতিসংঘের মূলমন্ত্র হচ্ছে- এ পৃথিবী আপনার, সবার জন্য জীবন, শান্তি, সমান অধিকার। জাতিসংঘের ৫টি সদস্য (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন) যাদের বিশেষ ক্ষমতা (ভেটো) রয়েছে, যার কারণে যে কোনো সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দিতে পারে।
কিন্তু জাতিসংঘ যে মূল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার কার্যকারিতা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ বিশ্বে শান্তি, সমান অধিকার, জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দ্ব›দ্ব-সংঘর্ষ প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। যেমন- পরাশক্তির দেশগুলো কীভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, দ্ব›দ্ব-সংঘর্ষ, ধর্মগত অসা¤প্রদায়িকতা ইত্যাদি এসব নিয়ে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা পরবর্তী কিছু দেশের উল্লেখযোগ্য দ্ব›দ্ব ও যুদ্ধ। যেমন- পাকিস্তান-ভারত দ্ব›দ্ব, ভারত-চীন দ্ব›দ্ব, ইরান-ইরাক দ্ব›দ্ব, পশ্চিম পাকিস্তান-পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও সম্প্রতি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। অর্থাৎ জাতিসংঘের মতো বৃহৎ সামাজিক সংগঠন থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই আছে। যদিও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ যুদ্ধ ব্যতীত কোনো ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি তবুও বিশ্বের পরাশক্তির দেশগুলোর মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ ইরান, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান এই দেশগুলোর মধ্যে কোনো না কোনো যুদ্ধ লেগেই আছে আর তার পেছনে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ভারত এসব দেশ অস্ত্র বা সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করে। অর্থাৎ এসব দেশ যদি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাহলে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কথাটা বলার মতো এই পৃথিবীতে কেউ থাকবে না।
বর্তমানে যদি বৃহত্তর শক্তিশালী ও পরাশক্তির দেশগুলো নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন, ভারত, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে যে পরিমাণ পারমাণবিক ও ভয়াবহ অস্ত্রের মজুত আছে তা দিয়ে সম্পূর্ণ পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য পর্যাপ্ত। বর্তমানকালে যেভাবে একটি রাষ্ট্র অন্য একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে তাতে এখন থেকে সচেতন না হলে, যুদ্ধ বন্ধ না করলে বা হিংসা, বিদ্বেষ ও বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলো ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার রোধ করা থেকে বিরত না থাকলে কিছুকাল পর হয়তো গোটা বিশ্ব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।

প্রীতম দাস : লেখক, ঢাকা।
[email protected]