Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

আমাদের ভাতঘুমে থাকলে চলবে না

সমাজ, বন্ধু, আত্মীয়, সখা, প্রতিবেশী বিবর্জিত এক আপন বৃত্তে সীমায়িত জীবনের দিকে এগুচ্ছে মানুষ। শহরগুলো এ বিধিতে কবেই আক্রান্ত হয়েছে। এবার এই ব্যাধির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে মফস্বলে, গ্রামে, অজ পাড়াগাঁতেও। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত লোভ এখন স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চাহিদায় বদলে গেছে। যা তার চাই, যেভাবেই হোক হাসিল করা চাই। মানুষ তার চাহিদা অনুযায়ী সম্পর্কের বিন্দুগুলো নির্মাণ করছে। ভেঙে যাচ্ছে অমলিন সামাজিক সম্পর্ক। ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে জন্মসূত্রে পাওয়া বন্ধনগুলো। কিন্তু আসলে তো মানুষ সামাজিক জীব। তাই যখন সামাজিক বন্ধনগুলো শিথিল হচ্ছে তখনই কৃত্রিম সামাজিকতার হাতছানিতে সে আকৃষ্ট হচ্ছে। যার নাম সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম। বন্ধু নামক অকৃত্রিম সম্পর্কেও ঢুকে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুকের দৌলতে এখন একেকজনের ১-৫ হাজার বন্ধু। শহর-গ্রাম, দেশের সীমা ছাড়িয়ে তার বন্ধুর পরিধি বাড়ছে হু হু করে। আজকের প্রজন্মের সামনে তাই বন্ধুর দুনিয়া দেখানো সাইকেল নেই, মাঠের কাদায় গড়াগড়ি নেই, হাঁটতে হাঁটতে নিরুদ্দেশ হওয়া নেই, এক্কাদোক্কা নেই, হাডুডুডু নেই, ঘুড়ি-নাটাই নেই, মার্বেল খেলা নেই, সাইকেলের টায়ার ঘোরানো নেই। আছে শুধু দূরে দূরে কিছু সম্পর্কের বিন্দু। যার পোশাকি নাম বন্ধু। ফেসবুক ফ্রেন্ড। কিছু লিখলে যারা লাইক দেয়। বাপ মরার খবর পেলে যারা জওচ লিখে। তাই যখন পরিবারে কেউ রাতবিরেতে অসুস্থ হয় তখন আশপাশে ডাকার মতো ভরসার কেউ নেই। রাত জেগে রোগী দেখার কেউ নেই। পিঠে হাত রেখে, ‘আমি তো আছি’ বলার কেউ নেই! এমনই এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সময়। এ সংকট আরো ঘনীভূত হবে।
স্বার্থের টানাপড়েনে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এই সংকটের সূত্রপাত। গ্রাম ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হয়ে এই সংকটের মাত্রা বৃদ্ধি। আর সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্তে এই সংকট এখন ঘনীভূত।
বিশ্বে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় চারশ কোটি। ভারতে এ সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি। তবে একজন গ্রাহকের দুটি বা তিনটি ফোন যে নেই তা নয়। খুব দ্রুত ফিচার ফোন থেকে স্মার্টফোনে বদলে যাচ্ছে গ্রাহক। বিশ্বে প্রায় ৩৬.৮ শতাংশ মানুষ এখন ফেসবুকে আছেন, যা সামাজিক মাধ্যমের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। করোনাকালে মানুষের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য যেমন দ্রুত বেড়েছে সামাজিক মাধ্যমের বাজার তেমনি শিক্ষা বাণিজ্য, অফিস-আদালতের কাজেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে এক অপরিহার্য মাধ্যম। বৈশ্বিক মহামারিতে থমকে যাওয়া জীবনকে বিকল্প পথে বাঁচিয়ে রেখেছিল এই ব্যবস্থা। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত আগ্রহ আর হাতছানি গোটা সমাজকে এক যান্ত্রিক জীবনের পথে টেনে নিয়ে গেছে। এখান থেকে ঘুরে আসা আর সম্ভব নয়। ঘুরে আসা হয়তো পিছিয়ে যাওয়ার নামান্তর হবে। কিন্তু সমাজ আর সম্পর্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর যে কুপ্রভাব দেখছি তা বিচলিত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আজ আমরা যখন কোনো নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে যাই তখন আলাপ-আলোচনার কোনো প্রাণ খুঁজে পাই না। বাড়ির কচিকাঁচা থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত সবার হাতে হাতে মোবাইল। সবাইকে যেন চুম্বকের মতো টেনে রেখেছে মোবাইল।
এরই ফাঁকে ফাঁকে কিছু কথা হচ্ছে। ইউটিউব দেখতে দেখতে বা চ্যাট করতে করতে টুকটাক কথা। এর মধ্যেই ঘড়ির কাঁটা ধরে এসে যায় টেলিভিশনের অলীক কুনাট্যগুলো। তখন নিজেকে অযাচিত-অবাঞ্ছিত অতিথি মনে হয়। এক সময় সব পাড়ায় একটা টেলিভিশন ছিল। পাড়াসুদ্ধ লোক একসঙ্গে বৈঠকখানায় বসে টিভি দেখত। এখন বহু বিত্তবানের ঘরে একাধিক টেলিভিশন। প্রত্যেকের পছন্দ আলাদা আলাদা। একাকিত্ব-নিঃসঙ্গতায় তলিয়ে যাচ্ছে একটা একটা পরিবার। যে কচিকাঁচাদের হাতে আমরা সময়ের তাগিদেই মোবাইল তুলে দিয়েছি আমাদের সময় কোথায় ঘুরে দেখার তারা কী দেখছে! সব চ্যানেল বা গেম তো আর শিশুবান্ধব নয়। তাই সময়ের আগেই তারা জেনে যাচ্ছে অনেক গূঢ় কথা। শিশুর শরীরে জাকিয়ে বসছে একটা পরিপক্ব মানুষ। তার কাছে শৈশব বলে কিছু নেই। তার কল্পনায় এখন অর্থ প্রতিষ্ঠা সুখের অথৈ সাগর। কিন্তু এই বয়স তো তার এসব ভাবার নয়। এ বয়স রূপকথার গল্প শোনার। সহপাঠীদের সঙ্গে হই হই করে ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু কোথায় কে, সবই তো শূন্য!
তাছাড়া আজকের এই টাকা বানানোর দৌড়ে সন্তানকে সময় দেয়ার মতো অবস্থা কজন মা-বাবার আছে? সবাই দৌড়াচ্ছেন টাকা, সাফল্য, ক্যারিয়ারের পেছনে। নিজের অপারগতা ঢাকতে সন্তানের হাতে দিয়ে যাচ্ছেন মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ। সঙ্গে থাকছে মাসতুতো ভাই টেলিভিশন। যেখানে প্রতিনিয়ত দেখানো হচ্ছে সুখসাগরে জলকেলির দৃশ্য। দামি গাড়ি, লাস্যময়ী নারী। সুদর্শন যুবকের একাধিক তরুণীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। প্রায় প্রতিটি কাহিনীতে থাকছে কোটি কোটি টাকার গল্প। কথায় কথায় ফরেন ট্যুর। ধর্ষণ, রাহাজানি, পরকীয়া তো আছেই। সব দেখে দেখেই বড় হচ্ছে একটা প্রজন্ম। মনে ঘুরপাক খাচ্ছে একটা স্বপ্ন। যে স্বপ্নগুলো বাস্তবে অনৈতিক, অবাস্তব, অসাধ্য। কিন্তু কে বোঝাবে এসব? শিশুমনকে কে বারবার বলে দেবে যে ফ্যাক্ট আর ফিকশন এক নয়। এসব বিষয়ই মানবিক সম্পর্কের প্রতিদ্ব›দ্বী। সুস্থ সমাজচেতনা আর আত্মিক সম্পর্কের ঘাতক। এ অবস্থায় অভিভাবক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উটপাখির মতো মাটিতে মাথা গুঁজে থাকলে বিপদ বাড়বে। ক্রমবিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে বদলে যাওয়া সমাজ আর সময়ে অভিভাবক, শিক্ষক বা সমাজ হিতৈষীদের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। ছেলেমেয়েদের সময় দিতে হবে। আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। নিজেরা সামাজিক মাধ্যমে সময় কম ব্যয় করে মানবিক সম্পর্কে বেশি জোর দিয়ে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। শিশুদের তাদের শৈশবে টেনে রাখতে হবে। আমাদের ভাতঘুমে থাকলে চলবে না। তাদের নান্দনিকতা মানবিকতা বন্ধুময়তা ও পরিমিতিবোধে দীক্ষিত করতে হবে। না হলে নিঃসঙ্গ দীর্ঘ এই পৃথিবীতে ভালোবাসা শুকিয়ে যাবে। এ প্রজন্ম পথ হারাবে।

দীপঙ্কর ঘোষ
গল্পকার ও কলাম লেখক
শিলচর, আসাম।
[email protected]