Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

আতঙ্কে দিন কাটছে খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরাবাসীর

টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়

আজও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা,আম্পান ও সিত্রাংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়। ফলে আতঙ্কে আর দুশ্চিন্তায় দিন কাটচ্ছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার উপকূলবাসীর। প্রতিবছরই বাঁধ ভেঙে তিন জেলায় পানিবন্দি হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত এসব এলাকায় প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও টেকসই হচ্ছে না বেড়িবাঁধ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি না থাকায় প্রকল্পের নামে বরাদ্দ অর্থ লুটপাট হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছেন তারা।

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধ, সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ ও নদী খননসহ বিভিন্ন কাজে ২ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এ ছাড়া আরো ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা জেলার ১৫ নম্বর পোল্ডারের পুনর্বাসন প্রকল্পের ১ হাজার ২০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজও শুরু হয়েছে। খুলনা কয়রা উপজেলার জন্য ১৬০ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করা করেছে কর্তৃপক্ষ। বাগেরহাটের পানগাছী নদী ভাঙন প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হবে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ সাল ও ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়সহ একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ¡াসে দেশের বাঁধের অধিকাংশ নাজুক হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে শুধু সুপার সাইক্লোন সিডরে উপকূলীয় ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয় ৩৯১ কিলোমিটার। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়।

২০১৯ সালের ৪ মে ফনি, ওই বছরের ১০ নভেম্বর আঘাত হানে বুলবুল। ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে উপকূলীয় ১০ জেলার ৪৭৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। ২০২১ সালের ২৩ মে সাইক্লোন ইয়াস আঘাত হানে। ফনি ও বুলবুলের প্রভাবে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আম্ফানের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে যায় উপকূল অঞ্চল। এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই মহাসাইক্লোন ইয়াসের বিরূপ প্রভাবে বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় ৯৩টি বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই তিন জেলার প্রায় ৪০ কি. মি. বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়।

সিত্রাংয়ের প্রভাবে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড- ১ এর আওতায় খুলনার দিঘলিয়া, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া এলাকায় আধা কি. মি. বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়। এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে খুলনা পাউবো-২ এর অধীনে কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলার রাড়ুলী, সোলাদানা, লতা, দেলুটি, গদাইপুর, মহেশ্বরীপুর, পানখালী, তিলডাঙ্গা, বালিয়াডাঙ্গা, আমিরপুর ও ভাণ্ডারকোর্ট এলাকায় ৩০টি স্থানে প্রায় ১৭ কি.মি. বেড়িবাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ ও মোংলা এলাকায় ১৫টি স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৬ কি. মি. বেড়িবাঁধ। সাতক্ষীরা পাওবো-১ এর অধীনে গাবুরা, বিড়ালক্ষী, বুড়িগোয়ালিনী, কাশিমাড়ী, হরিনগর, রমজাননগর, কৈখালী, মুন্সীগঞ্জ ও দেবহাটা এলাকায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে ২১টি স্থানে ৭.১৯৫ কি. মি. বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে। সাতক্ষীরা পাওবো-১ এর আওতায় খুলনার কয়রা সদর, উত্তর বেতকাশী, দক্ষিণ বেতকাশী, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর এলাকার ২৬টি স্থানে প্রায় ১১ কি. মি. বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে। খুলনার ৯টি উপজেলার মধ্যে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়। ঘূর্র্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত তিন উপজেলার মধ্যে কয়রার ৬টি ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। কয়রা উপজেলার হরিণখোলায় ১৪০ মিটার, সাখবাড়িয়ায় ৩ হাজার মিটার ও গাতিরঘেড়ীর ১শত মিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে।

ষাটের দশকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ৩০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। ষাট বছরে ভাঙতে ভাঙতে যার অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে। ???গাবুরার দক্ষিণ পশ্চিমে খেলপেটুয়া নদী, উত্তর দক্ষিণে কপোতাক্ষ নদ। অর্ধশত বছরেরও আগে নির্মিত এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের ধাক্কা। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় চরম আতঙ্কে আর দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে এলাকাবাসীর। প্রতিবছরই বাঁধ ভেঙে তিন জেলায় পানিবন্দি হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা,আম্পান ও সিত্রাংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত এসব এলাকায় প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ হচ্ছে না। যে কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই বাঁধ ভেঙে নোনা পানিতে বন্দি হয়ে পড়ছে উপকূলবাসী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি না থাকায় প্রকল্পের নামে বরাদ্দ অর্থ নয়ছয় হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের।

পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সফি উদ্দিন বলেন, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদী খননসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। সে অনুযায়ী তিন জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে কাজও শুরু হয়েছে। তিনি জানান, কয়রা উপজেলার ১৪/১ পোল্ডারের পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় ১৩ কি. মি. বেড়িবাঁধ, ৩ কি. মি. ঢাল ও ১১ কি. মি. নদীর তীর প্রতিরক্ষামূলক পুনর্বাসনের জন্য ১২০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। একনেকে অনুমোদনের পর দেড় মাস আগে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এই কাজগুলো দ্রুত শুরু হবে। প্রকৌশলী মো. সফি উদ্দিন আরো বলেন, বাগেরহাট জেলার পানগাছি নদী ভাঙন প্রকল্প চলতি বছরের জুলাই মাসে পাস হয়েছে এডিপিতে। আগামী মাসে এ প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হবে।

সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আক্তার হোসেন জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপলোর গাবুরা ইউনিয়নের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ইউনিয়নের চার পাশে নদী থাকায় ঘূর্ণিঝড় হলেই প্রায় সবগুলো বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে যায়। যে কারণে চরম আতঙ্কে দিন কাটাতে থাকে উপকূলীয় এলাকাবাসী। তিনি জানান, গাবুরা ইউনিয়নটি মডেল ইউনিয়ন হিসাবে ঘোষণা করা হচ্ছে। সে কারণেই সব ধরনের উন্নয়ন কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, নদীর পাড় সংস্কারসহ ২১টি বান্ডেলের কাজ করা হচ্ছে বলেও জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা) আসনের সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কয়রা-পাইকগাছা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বরাদ্দ অর্থ ১৪/২ পোল্ডারের কাজে ব্যয় করা হবে। এ ছাড়া আরো ৩২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে জাইকা। তিনি বলেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ উন্নয়ন কাজের জন্য দেড় মাস আগে ৫০ কোটি টাকার টেন্ডার হয়েছে। আগামী ১৯ ডিসেম্বর আরো ১৬০ কোটি টাকার কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এমপি আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, কয়রার ১৪/২ পোল্ডারের নদী খনন, নদী শাসন , বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট নির্মাণ, ইট বিছানোর কাজের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কয়রা-পাইকগাছা এলাকায় ৩২০ কি. মি. বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিতে আছে ১২০ কি. মি. বেড়িবাঁধ।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, মোংলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনিসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘের মালিকদের কারণেই বেড়িবাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে বেড়িবাঁধের পাশে মাছের ঘের করছে। তারা বেড়িবাঁধের মধ্যে পাইপ দিয়ে পানি নিচ্ছে মাছের ঘেরে। যেকারণে বেড়িবাঁধগুলো দূর্বল হয়ে সেখানে ফাটল দেখা দেয়। তখন নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলেই পানির চাপে এসব বাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাধ সংস্কারের জন্য প্রকল্পে যে অর্থ বরাদ্ধ হয়, সেটা যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়না। যার অর্ধেকই লুটপাট হয় বলে অভিযোগ আশরাফের। খুলনা-বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন নাগরিক সমাজের এই নেতা। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অনেক গাফিলতি রয়েছে। আশরাফ-উজ-জামান আরো বলেন, উপকুলীয় এলাকার মানুষের এই দূর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রকল্প যারা তৈরী করেছেন তাদের আরো দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বরাদ্দ অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে।

অ্যাওসেডের নির্বাহী পরিচালক শামীম আরফীন বলেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আবাদি জমিতে নোনাপানি প্রবেশ বন্ধ করে কৃষির উৎপাদন বাড়ানো। অথচ এই বেড়িবাঁধগুলোর পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ নেই। এছাড়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কারে চলে সীমাহীন দুর্নীতি। তিনি বলেন, উপকূলীয় নদনদীর ভাঙনপ্রবণ অঞ্চল চিহ্নিত করে বাঁধ নির্মাণ এবং পুরনো বাঁধ সংস্কার জরুরি। এলাকার মানুষের সম্পৃক্ত করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে পরিকল্পিত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করার দাবি জানান তিনি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ শামীম আরো বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন আছে। সেখানে বেড়িবাঁধ সুরক্ষার প্রশ্নটিও এ আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় এ আইন বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। আইনটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে উপকূলীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষ দুর্যোগ-ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করেন অ্যাওসেডের নির্বাহী পরিচালক।