Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

বই ছাড়া শিক্ষাবর্ষ শুরুর শঙ্কা, প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ

সংকট হবে জেনেও দায়সারাভাবে শিক্ষা প্রশাসনের কাজ করা, গত বছরের বই ছাপানোর পর প্রকাশকদের জামানতের টাকা ফেরত না দেয়া, চলতি বছরে মাত্রাতিরিক্ত কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া এবং নোট-গাইডওয়ালা ও পেপার মিলের সম্মিলিত সিন্ডিকেটের কারণে কাগজের তীব্র সংকট হওয়ায় আগামী জানুয়ারিতে পাঠ্যবইয়ের সংকটে পড়বে দেশ। এর ফলে পাঠ্যবই ছাড়াই আগামী ১ জানুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু করবে শিক্ষার্থীরা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সংকটের কারণে এরইমধ্যে প্রাথমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কাজ। নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথমদিন অর্থাৎ আগামী ১ জানুয়ারি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ কোটি এবং মাধ্যমিকের জন্য ২৩ কোটির কিছু বেশি পাঠ্যবই ছাপানোর কথা। কিন্তু ছাপা বন্ধ হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীরা বই পাবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু বই নয়; সংকটের কারণে নতুন বছরে সব ধরনের শিক্ষা উপকরণও কিনতে হবে চড়া দামে।

প্রকাশকরা সিন্ডিকেট করার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, গত আগস্ট থেকেই বাজারে কাগজের সংকট শুরু হয়েছে, এখন সেটা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মধ্যেই কাগজের রিমের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এমনকি বেশি টাকা দিয়েও কাগজ পাচ্ছেন না অনেক প্রকাশক। শিক্ষা প্রশাসন অদক্ষতার কারণে বিষয়টি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, কাগজ সংকটসহ বেশ কয়েকটি কারণে প্রাথমিকের বই ছাপানো বন্ধ আছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, ছাপা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলমান থাকলেও সেটিও যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, কাগজ সংকটের কারণে প্রাথমিকের বই ছাপানো বন্ধ আছে বলে গতকাল রবিবার তিনি জেনেছেন। এখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, যত সংকটই আসুক শিক্ষার্থীদের হাতে যথাসময়ে পাঠ্যবই তুলে দিতে হবে। তবে প্রাথমিক

শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ বন্ধ থাকার কথা অস্বীকার করে ভোরের কাগজকে বলেন, গতকাল রবিবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠক হওয়ায় সংকট কেটে গেছে। আশা করছি ঠিকঠাক সময়েই শিক্ষার্থীরা বই পাবে।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, অধিকাংশ ছাপাখানায় প্রাথমিকের বই ছাপানো বন্ধ আছে। মাধ্যমিকের বই ছাপানোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ভালোমানের কাগজের সংকট থাকায় নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকে এক কোটি বই এখনো ছাপানো হয়নি।

মুদ্রণকারীরা জানায়, ২০২৩ সালের জন্য এনসিটিবি ৩৩ কোটি ২৮ লাখ বই ছাপাচ্ছে। কিন্তু কাগজ সংকটে প্রাথমিকের সব শ্রেণি ও মাধ্যমিকের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির নতুন কারিকুলামের বই ছাপার কাজ এখনো শুরু হয়নি।

জানা গেছে, বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপার কাগজ উৎপাদনের মূল উপকরণ ‘ভার্জিন পাল্প’। আগে ছাতক, পাকশী ও কর্ণফুলী পেপার মিলে কিছু পাল্প তৈরি হলেও এখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে আমদানি প্রায় বন্ধ। পেপার মিলগুলো এলসি করতে পারছে না। এতে পুরনো কাগজ রিসাইকেল করে পাল্পবিহীন কাগজ উৎপাদন করছে মিলগুলো। কিন্তু সমস্যা হলো রিসাইক্লিং ফাইবারে তৈরি কাগজে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্দেশিত উজ্জ্বলতা আসে না। সম্প্রতি কয়েকটি ছাপাখানায় ৭০ শতাংশের কম জিএসএম কাগজেও বই ছাপার প্রমাণ পেয়েছে এনসিটিবি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রেস মালিক বলেন, দেশের বড় পেপার মিলগুলোর কাছেই পাল্প নেই। তারা ভার্জিন পাল্প দিয়ে পেপার তৈরি করে। রিসাইকেলের মধ্যে ৫০ শতাংশ পাল্প মেশানো গেলে ৮২-৮৩ শতাংশ উজ্জ্বলতা আসে। কিন্তু তাদের কাছে দেয়ার মতো সেই ৫০ শতাংশও নেই। সে কারণে তারা অফিস-আদালতের বাতিল কাগজ দিয়ে নতুন কাগজ তৈরি করছে। এতে ভালোমানের কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশে ১২০টির মতো কাগজ মিল রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টির মতো মিল এনসিটিবি নির্ধারিত মানের কাগজ উৎপাদন ও সরবরাহ করে। পাল্প আমদানি বন্ধ থাকা, গ্যাস সংকট, আনুষঙ্গিক অন্যান্য পণ্যের লাগামহীন দাম বাড়ায় ১৫টি মিলের মধ্যে অন্তত সাতটি প্রতিষ্ঠান কাগজ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এ কারণে কাগজের সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে। ফলে সিন্ডিকেট করে মিলগুলো সংকট দেখিয়ে কাগজের দাম প্রতিনিয়তই বাড়াচ্ছে। তারা প্রেসগুলোকে দিচ্ছে নিম্নমানের কাগজ। নভেম্বরের শুরুতে ৮০ জিএসএমের ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা দামের এক টন কাগজের দাম ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। ৬০-৭০ জিএসএমের কাগজের দাম ছিল ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা। নভেম্বরের শুরুতে সেই কাগজের দাম লাখ ছাড়ায়। এখন তার দাম ১ লাখ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

ছাপাখানাগুলোর মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সম্প্রতি প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে তারা বিলসহ প্রাথমিকের বই ছাপানোর সঙ্গে জড়িত সবকিছু এনসিটিবিকে দেখভালের অনুরোধ করেছে। রাজধানীর মাতুয়াইলের এক প্রেস মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের টেন্ডার, চুক্তি, জরিমানা সবকিছু হয় এনসিটিবির সঙ্গে। কিন্তু টাকা আটকে থাকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে। আবার বিল জমা দেয়ার পর টাকা পেতে ২-৩ মাস সময় লাগে। এ কারণে সবাই মিলে প্রাথমিকের বই ছাপানো বন্ধ রেখেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চুক্তি অনুযায়ী নিম্নমানের বই দিলে ছয় মাসের মধ্যে নতুন বই সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি জরিমানাও গুনতে হবে। কিন্তু ৯-১০ মাস পার হওয়ার পরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। শুধু তাই নয়, একটি বাদে গত বছর পাঠ্যপুস্তকের কাজ করা কোনো প্রতিষ্ঠানেরই জামানতের টাকা ফেরত দেয়নি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। ফলে কাগজ মিল মালিকদের দেনা পরিশোধ করতে পারেনি ছাপাখানাগুলো। এ কারণে তারা এবার যথা সময়ে কাগজের চাহিদাপত্র দিতে পারেনি। মিলগুলোও কাগজ উৎপাদনের উপকরণ সংগ্রহ করেনি। আবার জামানতের টাকা না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো এবার ব্যাংক থেকেও ঋণ পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকের বইয়ের কাজ নিয়েও না করার কথা জানিয়ে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে আনন্দ প্রিন্টার্স, অ্যাপেক্স ও পেপার প্রসেসিং এন্ড প্যাকেজিং। তারা তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ১০ লটের কাজ ফিরিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল ভোরের কাগজকে বলেন, প্রকাশনা শিল্প গুরুতর একটা সংকটে পড়েছে। এটা এখনি সমাধান করা না গেলে সামনের বছর শুধু বিনামূল্যের ৩৩ লাখ বই নয়, অন্যান্য ক্লাসের, নাইন-টেনের, ইন্টারমিডিয়েটের সব বই পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে। ফলে গত কয়েক বছর ধরে জানুয়ারির শুরুতে প্রাথমিকে যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনেক প্রকাশক জানিয়ে দিয়েছেন, কাগজ সংকট ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তারা ঠিক সময়ে বই সরবরাহ করতে পারবেন না।

পাশাপাশি অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকের দাম আগের তুলনায় দেড় থেকে দুই গুণ বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন প্রকাশকরা। সেইসঙ্গে স্কুল-কলেজের পড়াশোনায় প্রয়োজনীয় সাদা কাগজের অভাব বা দাম অনেক বেড়ে যাওয়ারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তারা। কারণ বছরের শেষ দিকে নানা বই ছাপানো, ক্যালেন্ডার-ডায়েরি থেকে শুরু করে মুদ্রণ খাতে কাজ বেড়ে যায়।

শ্যামল পাল বলেছেন, আমাদের র’ ম্যাটেরিয়াল নেই, বিদ্যুৎ নেই। নতুন বছরে ডজন ডজন খাতা লাগবে। আরো বিভিন্ন খাতে কাগজ লাগে বাংলাদেশে। ইমপোর্টও হচ্ছে না। এখন কাগজ যা আছে, তা দিয়ে হয়তো আর কিছুদিন চলবে। কিন্তু দ্রুত কাগজ উৎপাদন বা আমদানি করা না গেলে ভয়াবহ সংকটে পড়তে হবে আমাদের।

প্রকাশকরা দাবি করছেন, সংকট সামলাতে তাদের যেন সাময়িকভাবে কয়েকমাসের জন্য শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু তাতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় আপত্তি রয়েছে কাগজ মিল মালিকদের।

কেএইচ