Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

বিদ্যুৎ বিপর্যয় মোকাবিলায় স্মার্ট গ্রিডের প্রয়োজনীয়তা

২০১৪ সালের পর গত ৪ অক্টোবর কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে মহাভোগান্তির শিকার দেশের অর্ধেক জনগণ। গত মঙ্গলবার জাতীয় গ্রিড পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়ার কারণে পুরোপুরি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ প্রায় ৩২টি জেলা। জাতীয় গ্রিড কী এবং কারা এর পরিচালনা করেন? জাতীয় গ্রিড হচ্ছে সারাদেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করার একটা ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীরা জাতীয় গ্রিডকে অনেকটা প্রধান মহাসড়ক বা রেললাইনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই জাতীয় গ্রিড থেকে শাখা লাইন দিয়ে বিভিন্ন লোকালয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয়।
বাংলাদেশে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড জাতীয় গ্রিড পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। এই জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে ঢাকা শহরে প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী বিদ্যুৎহীন ছিল, দেশের কোথাও কোথাও ৮ ঘণ্টারও অধিক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিল। এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে দেশের কোটি কোটি মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে। এছাড়া গত ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছিল। সেই সময় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অধিকাংশ এলাকায় প্রায় দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। এবারের জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ বিদ্যুৎ বিভাগের বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে ২টা ৫ মিনিটের দিকে এই বিপর্যয় ঘটে তারপর বিদ্যুৎ বিভাগের অসচেতনতা ও অদক্ষ জনবলের কারণে দীর্ঘ সময় পর সন্ধ্যা ৬টার দিক থেকে আস্তে আস্তে বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হয়। কোনো কোনো জায়গায় রাত ১০টা অবধি বিদ্যুৎ সঞ্চালন স্বাভাবিক করা যায়নি।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে পুরো দেশ (ব্ল্যাক আউট) অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ব্যাহত হয় দেশের চিকিৎসা, ব্যাংক লেনদেন ও টেলিযোগাযোগসহ জরুরি সেবা খাতগুলো।
বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎবিহীন জীবন কল্পনা করা যায় না, দেশের উন্নতির জন্য যেসব খাত গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ ছাড়া এখন কোনো কিছুরই বাস্তবায়ন অসম্ভব। দেশ ডিজিটাল হওয়ার কারণে সব সেবা এখন মোবাইল ও কম্পিউটারনির্ভর হয়ে পড়েছে আর এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস চলে বিদ্যুতে। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে হাসপাতালে রোগী, ডাক্তার, নার্স অপরিসীম কষ্ট ভোগ করেছে, যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। অনেক জরুরি অপারেশনের রোগীর অপারেশন করা সম্ভব হয়নি। এতে অনেক রোগী প্রাণ সংশয়ের মাঝে পড়ে যায়। এমন ভোগান্তি কোনোভাবেই আমাদের কাম্য নয়। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাংকের এটিএম বুথগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ায় পুরো দেশে লেনদেন আটকে ছিল সেই কারণে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্থনীতির গতি সঞ্চালন মহাবিপর্যয় দেখা দেয়। ব্যাংকের সুইফট বার্তা আদান-প্রদান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে অতীব জরুরি এলসি খোলা ও সুইফটে প্রেরণ করা সম্ভব হয়নি বিধায় অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
মুঠো ফোনের সেবা বিঘিœত হওয়ায় দেশ-বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিকাশ, রকেট, সহজ বা অন্যান্য মাধ্যমে টাকা আদান প্রদান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে। সাধারণ যোগাযোগও ব্যাহত হয়। মুঠোফোনের চার্জ ফুরিয়ে গেলে পুনরায় চার্জ করা সম্ভব হয়নি, অন্যদিকে নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে মুঠো ফোন কোম্পানিগুলোও বিপর্যস্ত হয়।
কলকারখানার উৎপাদন ২০-৩০ শতাংশ ব্যাহত হয়েছে বেশির ভাগ অঞ্চলে। এমনিতে বর্তমানে বিশ্ব মন্দার কবলে পড়ে পুরো পৃথিবী অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকছে, এই অবস্থায় উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশ আরো পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। শহুরে মানুষ বিদ্যুৎ না থাকলে সাধারণত জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু সেখানেও মানুষ বিড়ম্বনার শিকার; তাদের ডিজেল কিনতে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে ভিড় করতে দেখা গেছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে বিদ্যুৎ ছাড়া তো আর পাম্প চলে না, সেই ক্ষেত্রে এখানেও মানুষের চরম ভোগান্তি লক্ষ্য করা গেছে। আদালতের জরুরি বিচার কার্য ব্যাহত হয়েছে। আদালতে মোমবাতি জ্বালিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসব শেষ, অন্ধকারের মাঝে দুষ্কৃতকারীরা যেন বিঘœ ঘটানোর চেষ্টা করতে না পারে তার জন্য বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল।
অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার সময় এই বিপর্যয় ঘটে, কিন্তু কী কারণে এমন বিপর্যয় ঘটল তা তিনি বলতে পারেননি। এখন পর্যন্ত বিপর্যয়ের কারণ জানাতে পারেনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা বা অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা ও সাধারণ জনগণ অতীত থেকে কোনো শিক্ষা নেয় না, এটা তার জ¦লন্ত প্রমাণ। ২০১৪ সালের বিদ্যুতের মহাবিপর্যয়ের পরও ঘোড়াশাল গ্রিডের এখন পর্যন্ত কোনো আধুনিকায়ন করা হয়নি। সেই কারণে পুনরায় একই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দেশ।
২০১৪ সালের বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয় হলো একটি শিল্প বিপর্যয়, যেটিতে সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনা ঘটেছিল ১ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টা ২৭ মিনিট ৪১ সেকেন্ড থেকে একনাগাড়ে ১২ ঘণ্টা অর্থাৎ ২ নভেম্বর মাঝরাত পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই বিপর্যয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হিসাবে ধরা হয়, এর ফলে প্রায় ১৬ কোটি নাগরিকের জীবনযাপনের ওপর প্রভাব পড়ে এবং চরম দুর্ভোগের মধ্যে পতিত হয়।
জাতীয় গ্রিডে ত্রæটির কারণে ১ নভেম্বর সকাল থেকে সারাদেশের সব জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এত দীর্ঘ বিদ্যুৎ বিপর্যয় এটাই প্রথম। সেই সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় দাবি করেছিল যান্ত্রিক ত্রæটির কারণে ওই ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। ফলে বিদ্যুৎ সংকট দীর্ঘায়িত হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। ১ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় একে একে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবনসহ অন্যান্য সরকারি ভবনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে। বিদ্যুতের এমন বিপর্যয় আগে কখনো ঘটেছে বলে কেউ স্মরণ করতে পারেননি।
বাংলাদেশ এখন স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে, সেটা অবশ্যই ভালো খবর। মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে কী কী খাত গুরুত্বপূর্ণ এবং তার উন্নয়ন করা জরুরি তা কি আমাদের দেশের কাণ্ডারিরা জানেন-বোঝেন? মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক দেশের বিশেষ শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।
২০১৪ থেকে ২০২২ সালের ব্যবধান একটা দীর্ঘ সময় অথচ বিদ্যুৎ বিপর্যয় সামাল দেয়ার সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় হয় এমন উদাহরণ আমেরিকা, কানাডাসহ ইউরোপের অনেক দেশে আছে; কিন্তু তাদের সক্ষমতা আছে অতি দ্রুত সেই বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করার।
আমাদের দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাতে খরচ করছে সরকার এবং এই খাতের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষা করতে দায়মোচন আইন করা হয়েছে। এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের দায়ভার কার ওপর বর্তাবে? এর জন্য কে দায়ী? বা এই অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের দায়িত্ব কে নেবে? শুনেছি বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে! অতীতেও বিভিন্ন বিপর্যয়ে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে সেই সব কমিটির রিপোর্ট কোনো সরকারের আমলেই আলোর মুখ দেখেনি। এবারেও যে তার ব্যত্যয় ঘটবে না এই ব্যাপারে হলফ করে বলা যায়। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে। যদি এ ধরনের অবহেলার ক্ষেত্রে এমন উদাসীনতার প্রশ্রয় দেয়া হয় তাহলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন।
দুঃখের বিষয় হলো এত এত টাকা খরচ করা হলেও মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইন পরিবর্তন বা সুচারু রূপে মেরামত করা হয়নি। অধিক ব্যয়বহুল ও অস্থায়ী বিদ্যুৎ ব্যবস্থা কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের মাধ্যমে সাময়িক বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা গেলেও এখন এটা গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতার কারণে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সঠিকভাবে সঞ্চালন করা যায় না। এই জরাজীর্ণ লাইনে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করতে গিয়ে এ ধরনের গ্রিড বিপর্যয় ঘটে যা দেশের জনগণ ও অর্থনীতিকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়।
তাই স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনীতির ভিত মজবুত এবং জবাবদিহিতাসহ সুশাসন অত্যন্ত জরুরি তা না হলে মধ্যম আয়ের দেশের তকমা গলায় ঝুলিয়ে এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও এতে দেশের ও জনগণের তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। দক্ষ ও সৎ প্রশাসন ছাড়া কোনো দেশে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই জনকল্যাণ ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে তোলা উন্নয়নের পূর্বশর্ত, এতে দেশের যেমন উন্নতি হবে সেই উন্নয়নের উপকারভোগী হবে আমজনতা।

রবি রায়হান : কবি ও কলাম লেখক।
[email protected]