Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

নারী ফুটবলারদের সাফল্যে সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা

বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের দেশ। এখানে পুরুষতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা বিদ্যমান। সাধারণত আমাদের সমাজে নারী বা মেয়েদের পুরুষের মেজাজ-মর্জিমাফিক চলাফেরা এবং পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে বাধ্য করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে মেয়েদের অন্য কোনো একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করতেও দেয়া হয় না। অক্ষর-জ্ঞানহীন অন্ধকারে রেখে চার দেয়ালে বন্দি করে রাখা হয়। তাদের কোনো অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ নেই। ধর্মে একজন নারীকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এটার উল্টো ব্যাখ্যা দিয়ে নারী জাতিকে সমাজে পুরুষের মুখাপেক্ষী করে রাখার কুশলী বন্দোবস্ত তৈরি করে রাখা হয়েছে। বৈষম্য সৃৃষ্টিকারী মানসিকতা ও নারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ইসলাম ধর্মেও অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। একজন নারীর বিকশিত হওয়ার সব পথ রুদ্ধ করে কিছুসংখ্যক মানুষ নিজেদের পুরুষত্ব জাহির করতে ব্যস্ত।
সেখানে একজন নারী ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে ফুটবলের জার্সি, হাফপ্যান্ট, বুট পরে লাখো জনতার সামনে ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি করবে এটা আমাদের দেশের অনেক কট্টর ধর্মবিশ্বাসী মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেন না। এত বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও কিছু সাহসী নারী নিজেদের ভাগ্যবদলের তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে ফুটবল হাতে তুলে নেন। তারা সমাজের কিছু আলোকিত মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় নিজেদের ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এই পর্যন্ত এসেছেন এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সাফ ফুটবলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এখনো তাদের পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। আধুনিক সমাজে দাঁড়িয়েও অন্ধকারে নিমজ্জিত কিছু মানুষ নারীদের কোনো সাফল্যই মেনে নিতে পারছে না। এই নারী ফুটবলারদের এত বড় একটা সাফল্য এটাকে খাটো করে দেখার জন্য ধর্মের দোহাই তাদের বড় হাতিয়ার। দিনের পর দিন একটি পরিবার অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করেছে অথচ সাহায্যের একটি হাতও কেউ বাড়ায়নি। তারা নিজে পরিশ্রম করে সৎপথে থেকে অর্থ উপার্জন করে নিজের ও পরিবারের ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করছে। তাদের অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পর্যন্ত নেই। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক ঝর্না চাকমার একটি বসতঘরের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। এটা কি কোনো ঘর? এই ছবি দেখে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের বসবাস করার জন্য বাড়ি নির্মাণের আদেশ দিয়েছেন। এই সাফল্য না পেলে হয়তো ঝর্না চাকমার বসতঘরের স্বপ্নসাধ অপূর্ণই রয়ে যেত।
তারা নিজেদের ভাগ্য বদলের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মুখও উজ্জ্বল করছে- এটা নিশ্চয় একটি সম্মানিত পেশা ও কাজ। পেছনে থেকে সমালোচনা না করে ভালো কাজের জন্য অনুপ্রেরণা দেয়া সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিত। ধর্মীয় ফতোয়া না ঝেড়ে মানবতার সেবায় এগিয়ে এসে তাদের সবার সামাজিক ও আত্মিক মর্যাদা বৃৃদ্ধি করতে সাহায্য করা কোনো অংশেই কম পুণ্যের কাজ নয়। তারা আজ নিজেদের যোগ্যতায় ও কঠিন পরিশ্রম করে এত কিছু অর্জন করেছেন। এই অর্জনটুকুকে কোনো দোহাই দিয়ে দয়া করে খাটো করার চেষ্টা না করে নারীদের বাহবা দেয়া বাংলাদেশের জনগণের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দেখবেন এরাই একদিন সব আগল ভাঙবে, সেদিন সব ধরনের পরিবার থেকেই নারী ফুটবলার তৈরি হবে। শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষা। বাংলাদেশ নারী দল ভারত ও নেপালের মতো শক্তিশালী নারী দলকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। সমাজের কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের বাধা ও কটূক্তির বিপরীতে যুদ্ধ করে কৃষ্ণা, সাবিনাদের যুদ্ধ কিছুটা হলেও সফলতার মুখ দেখেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে হাতে-পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে মানুষের অধিকার খর্ব করা অন্যায় ও স্বাধীনতা হরণের শামিল। মনে রাখতে হবে এটা একটা খেলা এবং সব খেলারই একটা নিয়ম-কানুন থাকে ও পোশাক-পরিচ্ছদ থাকে। তা মেনেই খেলতে হয়। আমাদের দেশ ছাড়াও অনেক মুসলিম দেশে নারী ফুটবল দল আছে এবং তারাও আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলে। আমাদের দেশের মতো কট্টরপন্থি ধর্মগুরুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের উদাহরণ দেন। তাদেরও জানা উচিত পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরান, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশের নারীরা আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলে। যুগ বদলেছে। মানুষ এখন অনেক পড়ালেখা করেন, ধর্ম সম্পর্কেও অনেক জ্ঞান রাখেন। সবকিছুর সঙ্গে ধর্ম গুলিয়ে ফেলে এখন আর মানুষকে গোমড়া করা সহজ হবে না। আমাদের সমাজে নারী এখন অনেক অগ্রগামী, যেমন দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার ও শিক্ষামন্ত্রীসহ অনেক বড় বড় পজিশনে নারী নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সবার তো আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরকার নেই, সেই যোগ্যতা ও মেধা সবার এক হয় না। তাই ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করলে ক্ষতি কি?
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি মো. নাজমুল হাসান পাপন নারী ফুটবলারদের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং নারী ফুটবল দলের জন্য ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। নারী ফুটবল দলের সাফল্যে দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সাফ) চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী নারী ফুটবল দলের জন্য ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এছাড়া কলসিন্দুরের আট নারী ফুটবলারের জন্য ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক সর্বমোট ২ লাখ টাকা ঘোষণা করেছেন, প্রতিটি নারী ফুটবলারের পরিবার ২৫ হাজার টাকা পাবে। অন্যদিকে এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদীর স্ত্রী শারমিন সালাম নারী ফুটবল দলের জন্য ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। আমাদের দেশে উদার মনের মানুষের সংখ্যা বেশি এবং তারা নারী ফুটবল দলের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করতে বিভিন্ন ধরনের মানসিক ও আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো একটি সুশৃঙ্খল ও পেশাদার বাহিনীও নারী ফুটবল দলকে অনুপ্রাণিত করতে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা এক কোটি টাকা অনুদান ঘোষণা করেছে, যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিরাট ঘটনা। এই অনুপ্রেরণা বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে আরো সুসংগঠিত ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করবে এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে সচেষ্ট থাকবে। আমরা তাদের সুন্দর আগামীর জন্য শুভ কামনা জানাই।

রবি রায়হান : কবি ও লেখক, ঢাকা।
[email protected]