Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

রিজার্ভসহ আর্থিক সংকট : বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হতে যাবে কেন?

সম্প্রতি মূলধারার গণমাধ্যমে বিশেষত টেলিভিশন টকশোর বড় অংশজুড়েই থাকছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, রিজার্ভ এবং শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গ। উপর্যুপরি কয়েকটি লেখায় এবং আলোচনায়, বাংলাদেশকে কিছুটা জোর করেই শ্রীলঙ্কা বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হতে যাবে কেন? আজকের লেখাটা মূলত এই বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্যই। এ কাজটি করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ব্যবহার করে, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করেছি একটি উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য। এক্ষেত্রে আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিশ্বব্যাংকের তথ্যভাণ্ডারের সর্বশেষ উন্মুক্ত তথ্য ব্যবহার করেছি। বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে যারা সন্দেহপ্রবণ তারা প্রায়ই বিশ্বব্যাংকে হাজের নাজের করে কথা বলতে পছন্দ করেন। প্রথমে আসা যাক দেশের সর্বমোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পর্কে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে রিজার্ভ ছিল ৪৬.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যখন এই লেখা লিখছি, সে সপ্তাহে এই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে যাওয়ায়, অনেকেই গেল গেল বলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছেন। আমাদের কি মনে আছে- ২০০৯ এ নির্বাচিত নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল মাত্র ১০.৩৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নিয়ে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যখন সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন পূর্ববর্তী সরকার মাত্র ৩.৮৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রেখে গিয়েছিল। কই তখন তো কেউ রিজার্ভ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি। তাহলে আজকে ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ায় তাদের এত উদ্বেগের কারণ কী, বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা না অন্য কিছু? প্রশ্নটি রাখছি এই জন্য যে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৮২ দেশের রিজার্ভের মধ্যে ১৪০টি দেশের রিজার্ভ বাংলাদেশের চেয়ে কম। বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বলি। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশের ভেতরে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, গ্রিসসহ ১৭টি দেশের চেয়েও বাংলাদেশের রিজার্ভ বেশি।
এবার আসি তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোর দিকে। আরব অঞ্চলের ১৫টিসহ আরব বহির্ভূত মোট ২৫টি তেলসমৃদ্ধ অর্থনীতির মধ্যে ইরান, নাইজেরিয়া, কাতার, ব্রুনাই, ওমান, ভেনিজুয়েলাসহ ১৭টি দেশের রিজার্ভের চেয়েও বাংলাদেশের রিজার্ভ বেশি। একইভাবে বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি ওইসিডিভুক্ত (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোয়াপোরেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট) ৩৬ দেশের মধ্যে ১৬টির রিজার্ভ বাংলাদেশের চেয়েও কম। এবার দক্ষিণ এশিয়ার কথা না বললেই নয়। একমাত্র ভারত ব্যতীত বাকি কোনো দেশের রিজার্ভ বাংলাদেশের ধারে কাছেও নেই। আসুন একবার চোখ বুলিয়ে নিই- পাকিস্তানের রিজার্ভ ২২.৮১ বিলিয়ন, তারপরে রয়েছে নেপাল ৯.৬৬ বিলিয়ন, ভুটান ১.৫১ বিলিয়ন, মালদ্বীপ ০.৮০ বিলিয়ন। আর যে শ্রীলঙ্কা নিয়ে এত হইচই- এই বুঝি বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে গেল, তাদের রিজার্ভ ৫.৬৬ বিলিয়ন। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ কখনোই আহামরি কিছু ছিল না। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ ছিল পর্বতসমান। এই বিষয়টিতে আরো বিস্তারিতভাবে পরে লিখছি।
আর্থিক খাতের অবস্থা নির্দেশ করে যে কয়েকটি বিষয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো বৈদেশিক ঋণ ও জাতীয় আয়ের অনুপাত। বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বমোট বৈদেশিক ঋণ, জাতীয় আয়ের ০.৯৯ শতাংশ অর্থাৎ এক ভাগেরও কম। এবার দেখা যাক দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই অনুপাতটি কেমন? মালদ্বীপের সর্বমোট বৈদেশিক ঋণ জাতীয় আয়ের ৮.৩০ ভাগ, পাকিস্তানের ৩.৫ ভাগ, ভারতের ২.৯ ভাগ এবং ভুটানের ২.৬৮ ভাগ। আর শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ জাতীয় আয়ের ৬.৬৪ ভাগ, যেখানে বাংলাদেশের সর্বমোট বৈদেশিক ঋণ জাতীয় আয়ের এক ভাগের চেয়েও কম।
এবার আসা যাক অর্থনীতির আরেক নির্দেশক সর্বমোট বৈদেশিক রিজার্ভ ও বৈদেশিক ঋণের অনুপাতপ্রসঙ্গ। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট রিজার্ভ, বৈদেশিক ঋণের ৬৩.৭২ ভাগ। অবশ্য এটি ২০১৬ সালেও ছিল ৮৩.৮৯ ভাগ। এই ৪ বছরের ব্যবধানে এই অনুপাতটি প্রায় ২০ ভাগ নেমে যাওয়ায় যারা কিছুটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে চান, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমাদের সর্বমোট রিজার্ভ ছিল বৈদেশিক ঋণের ২৪.৭৮ ভাগ। অর্থাৎ আমাদের বৈদেশিক ঋণ ছিল রিজার্ভের ৪ গুণেরও বেশি।
এবার শ্রীলঙ্কার প্রসঙ্গে আসি। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বমোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ১০.০৫ ভাগ। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ, তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ১০ গুণ। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মাত্র ১.৫৭ গুণ। আমি বুঝি না, কোন যুক্তিতে বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করার মতন কাজ কেউ করতে পারে? নিম্নআয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে গড় রিজার্ভ গড় বৈদেশিক ঋণের ২৫.১৩ ভাগ। অর্থাৎ নিম্নআয়ের দেশগুলোর গড় বৈদেশিক ঋণ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ৪ গুণ। আর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর বৈদেশিক রিজার্ভের গড় তাদের গড় বৈদেশিক ঋণের ৬০.২০ ভাগ। এবার বলুন বাংলাদেশ কি ভয়ংকর কোনো ঋণের ফাঁদে আটকে গিয়েছে? জেনে রাখা ভালো, এক্ষেত্রে ১৩৭ দেশের মধ্যে ৮৫টির অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক নিম্নমুখী। যে তালিকায় রয়েছে আর্জেন্টিনা, কলোম্বিয়া, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, তার্কি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউক্রেন, মিয়ানমারসহ উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো পর্যন্ত।
দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনার আরেকটি বড় নির্দেশক হচ্ছে, গিনি কোইফিশিয়েন্ট, যার মাধ্যমে আয় বৈষম্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়। অনেকের লেখায় আজকাল হরহামেশাই দেখি বাংলাদেশের আয় বৈষম্য প্রকট। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে না লিখলেই নয়। গিনি কোইফিশিয়েন্ট ০-১ এর মধ্যে ওঠানামা করে। ০-এর কাছাকাছি থাকা মানে হচ্ছে আয় বৈষম্য একেবারেই কম। ১-এর কাছাকাছি থাকা মানে, আয় বৈষম্য তীব্র বা প্রকট। বিশ্বব্যাংকের উক্ত তথ্য ভাণ্ডার/ ডাটবেজে বাংলাদেশের সর্বশেষ গিনি কোইফিশিয়েন্ট উল্লেখ আছে ০.৩২৩ (২০১৬)। প্রথাগতভাবে বিভিন্ন কারণেই এই গিনি কোইফিশিয়েন্টের সূচকটি কখনোই খুব বেশি বড় ছিল না বাংলাদেশের। যেমন ২০০৫ এ ছিল, ০.৩৩২, ২০১০ এ ছিল ০.৩২১, ২০১৫ এ ছিল ০.৩২৪। যে কোনো বিবেচনায় এটি একটি ভালো অবস্থান।
তবে অর্থনীতির একটি সূচকে বাংলাদেশ হঠাৎ করেই ২০২০ সালের পরে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। সেটি হচ্ছে বাণিজ্য ভারসাম্য। নানা কারণেই যার মধ্যে চলমান প্রকল্পগুলোর উচ্চমূল্যের সরঞ্জাম ক্রয়সহ জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবং অন্যান্য কারণে ২০২০ সালে বাণিজ্য ঘাটতি ২৬.৬৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। এক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতিতে এগিয়ে রয়েছে ভারত (৬৫.০৫ বিলিয়ন ডলার), তারপরই রয়েছে পাকিস্তান (৩৪.৩৭ বিলিয়ন ডলার)। প্রশ্ন হলো কম বাণিজ্য ঘাটতিতে থাকার পরও কেন সাম্প্রতিক সময়ে নজিরবিহীন সংকটে পতিত হলো শ্রীলঙ্কা। তার কিছু উত্তর পূর্বেকার আলোচনা থেকেই পেয়েছি। এর বাইরেও আর একটি বড় কারণ হলো শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য ঘাটতি তার জাতীয় আয়ের (জিডিপি) প্রায় ৭.৫৭ ভাগ গ্রাস করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি ৬.৪ ভাগ, ভারতের ক্ষেত্রে মাত্র ২.০৫ ভাগ।
এরকমই আরেকেটি দুর্বল দিক হলো চলতি হিসাবে ঘাটতি। ২০২১ সালে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স (চলতি হিসাব) ঘাটতি ১৫.৫৩ বিলিয়ন ডলার হলেও, এটি ২০২০ সালে ছিল ১.১৯ বিলিয়ন উদ্বৃত্ত। ভেবে দেখার বিষয় আছে, ১ বছরের ব্যবধানে এই সূচকের কেন এত অবনমন এটি কি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে উতরিয়ে যাওয়া যেত না, কোভিড কালীন রপ্তানি বিপর্যয় সত্ত্বেও। এটি বলছি এই জন্য যে, ২০১৬ সালের পূর্বে এই সরকারের মেয়াদে কখনো কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সের ঘাটতি ছিল না।
আমার ভয় হয়, যারা বাংলাদেশ গেল গেল বলে আওয়াজ দিচ্ছেন, তারা তাদের শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আবার ১২ বছর পরে বাংলাদেশকে ওগঋ (আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল) এর দীর্ঘমেয়াদি খপ্পরে ফেলতে চাচ্ছেন কি-না। অতীত পরিসংখ্যান থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৬ মাসের মতো আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ রয়েছে। তারপরও কেন তড়িঘড়ি করে ওগঋ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে? এখানে একটি আশঙ্কা থেকেই যায়। আশঙ্কার কারণটি হলো অতীত অভিজ্ঞতা বলে, ওগঋ থেকে লোন নেয়া মানেই অযাচিত শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়া, দেশের আর্থিক সার্বভৌমত্ব নষ্ট হওয়া। সরকারকে সাধুবাদ জানাতে পারতাম, যদি ওগঋ এর ধারকর্য না করে ভোগ্যপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, এটিকে আরো কঠোর থেকে কঠোরতর করে এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প স্থগিত করাসহ ব্যয়সাপেক্ষ বড় প্রকল্প আপাতত গ্রহণ না করে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করত।
অতএব উপস্থাপিত তথ্যের আলোকে আমার কাছে মোটেই বোধগম্য নয়, কেন বারবার বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে বলে একটা কৌতূহল সৃষ্টি করা হচ্ছে। অবশ্য আজ থেকে এক দশক আগে আমরা যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নসহ কিছু সূচকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম এবং শ্রীলঙ্কাকে ছুঁতে চাইতাম, তখন হরহামেশাই কিছু লেখা চোখে পড়ত, যাদের বক্তব্যের সারকথা ছিল- শ্রীলঙ্কা হওয়া এত সহজ নয়। জানি না আজ যারা কথায় কথায় বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বানিয়ে ফেলছে, তখন কি তারাই শ্রীলঙ্কা হওয়া এত সহজ নয় বলে ছবক দিয়েছিল কি-না। পরিশেষে বলতেই হয়, বাংলাদেশ বাংলাদেশই থেকে যাবে। সমস্ত ধোঁয়াশা কাটিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমাজ জীবন উপহার দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে আবাক করে দিবে সবাইকে।

প্রফেসর ড. মোস্তফা সারোয়ার : কর্মকর্তা, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]