Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

রুমির প্রেম, প্রজ্ঞা ও দর্শন

আজ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রি.। মৌলানা জালালুদ্দিন রুমির ৮১৬তম জন্মদিবস। জালালুদ্দিন রুমি হলেন মহান মানবতাবাদী ও জগৎশ্রেষ্ঠ একজন আধ্যাত্মিক কবি ও দার্শনিক; তাকে বলা হয় ‘দ্য ম্যাসেঞ্জার অব লাভ এন্ড উইজডম’ অর্থাৎ প্রেম ও প্রজ্ঞার বার্তাবাহক। রুমি বলেছেন, ‘ইন সোখানে অবিস্ত আয দারয়ায়ে বিপায়ানে এশ্ক, তা জাহানরা অব বাখশাদ জেসমহারা জান কোনাদ’ অর্থাৎ সীমাহীন প্রেম দরিয়ার পানির কথা এটি, ধরনীকে পানি আর দেহে দেবে প্রাণ যেটি। কিন্তু আমাদের আজকের সমাজে সেই প্রেমেরই বড় অভাব। প্রেমের অভাবের কারণেই আমাদের মাঝে আজ অশান্তি বিরাজিত। মূলত সমাজদেহ থেকে শান্তি আজ তিরোহিত। কেননা বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছি, সমগ্র বিশ্বজুড়েই ধারাবাহিকভাবে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যার হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেই চলছে। মানুষের মাঝে অস্থিরতা, অস্বস্তি বিরাজ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজদেহে শান্তি-স্বস্তির বড় অভাব এবং ক্রমান্বয়ে তা আরো অধিকতর অশান্তির পানেই ধাবিত হচ্ছে। আমরা এ অবস্থার দ্রুত অবসান চাই। আর সেজন্য প্রয়োজন মানুষের প্রতি মানুষের দরদ ও দায়বদ্ধতা। সেটি তখনই আসে যখন মানুষের ভেতর অপরের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা থাকে, প্রেম থাকে।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে চরম অস্থির ও অশান্ত সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের দরদ ও দায়বদ্ধতা, মমত্ববোধ আর ভালোবাসার অনুপম সৌধের ওপর প্রেমের জয়গান গেয়ে যিনি শান্তিপিপাসু মানুষের জন্য এক ব্যতিক্রমী দর্শন প্রবর্তন করেন- তিনি হলেন মানবতাবাদী দার্শনিক, কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক জালালুদ্দিন রুমি। ৮১৬ বছর আগে জন্ম নেয়া অধ্যাত্মবাদের প্রাণপুরুষ রুমি তার কাব্য-সাহিত্য রচনায় এবং প্রেমদর্শন প্রচারে ফারসির পাশাপাশি আরবি, তুর্কি আর গ্রিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। জন্মেছেন আফগানিস্তানের বাল্খে, কীর্তিময়তার স্বাক্ষর রেখেছেন গোটা পারস্যে আর তীর্থস্থানে পরিণত হওয়া তার মাজার রয়েছে তুরস্কের কৌনিয়ায়। তিনটি দেশেই তিনি সমভাবে, সমমর্যাদায় সমাদৃত হয়ে আছেন। এ সৌভাগ্য পৃথিবীতে কেবলই তার। এর বাইরে সমগ্র বিশ্বে তিনি পরিচিত ও নন্দিত। অধ্যাত্মবাদের বিশ্বকোষ মসনভি শরিফে তিনি গেয়েছেন ২৬ হাজার দ্বিপদি বেইত; ফারসি ভাষার কুরআন খ্যাত এই মসনভি হচ্ছে মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক কাব্য সংকলন। ৪০ হাজার পঙ্ক্তিমালার সমারোহে বিন্যস্ত তার দেওয়ানে শাম্স তাবরিযি; প্রেমগীত হিসেবে বিশ্বসাহিত্যে যার তুলনা এটি নিজেই। এর বাইরে তিনি ৩৫ হাজার পারসিক শ্লোক এবং দুই হাজার রুবাইয়াত রচনা করেছেন। তার সমগ্র রচনার মূল সুর হচ্ছে প্রেম। সৃষ্টিকে ভালোবেসে স্রষ্টার ভালোবাসায় উন্নীত হওয়ার সিঁড়ি হচ্ছে তার এই প্রেম। সেজন্য তাকে বলা হয় দ্য ম্যাসেঞ্জার অব লাভ, প্রেমের বার্তাবাহক।
৮১৬ বছর আগের সেই অমর কবি আজো সারা বিশ্বে সমাদৃত। ইরান, তুরস্ক আর আফগানই শুধু নয়, কি প্রাচ্য আর কি প্রতীচ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ আর ইউরোপ-আমেরিকা সর্বত্রই রুমির কদর। পৃথিবীর বিখ্যাত সব ভাষায় রুমির কর্ম আজ অনূদিত, বিশ্বের প্রায় ১২টি দেশের জাতীয় কবি রুমির কাব্য দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আর পাকিস্তানের জাতীয় কবি ইকবাল তাদের অন্যতম। কোলম্যান বার্কস, আর এ নিকলসন, এনিমেরি শিমেল, এ জে আরবেরি, ই জি ব্রাউন, জুয়েল ওয়াইজলাল, উইলিয়াম ছিতিক্স, জাভিদ মোজাদ্দেদি, ফ্রাঙ্কলিন লুইস, নাদের খালিলি, বদিউজ্জামান ফরোযানফার, আব্দুল হোসেইন যাররিনকুব, ইব্রাহিম গামার্দ, সামির আসাফ প্রমুখ বিশ্বখ্যাত কবি ও গবেষক রুমিকে নিয়ে কাব্য-সাহিত্য ও মানবপ্রেমের দ্যুতি ছড়িয়েছেন। রুমির ৮০০তম জন্মজয়ন্তী পালন উপলক্ষে জাতিসংঘের উদ্যোগে ইউনেস্কো কর্তৃক ২০০৭ সালকে ‘দ্য ইয়ার অব রুমি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত রুমির জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মহাসচিব বান কি মুনের বক্তব্যটি ছিল তাৎপর্যমূলক। তিনি বলেছিলেন, বর্তমান বিশ্ব অন্য যে কোনো কিছুর চাইতে রুমির চিন্তাধারা প্রচারের অধিক মুখাপেক্ষী। কেননা রুমির কাব্যসম্ভারে শান্তি ও সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংলাপের আবেদন বা বাণী প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। আর এই বাণী হওয়া উচিত বিশ্বসমাজের কর্মতৎপরতা বা আচরণের আদর্শ। রুমি তার মানবপ্রেম, সহিষ্ণুতা, সমঝোতা ও দয়ার দর্শনের কারণে ৮০০ বছর পর আজো জীবন্ত রয়েছেন। সাম্প্রতিক যুগে বিভিন্ন জাতি ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব ও অসহিষ্ণুতা সৃষ্টির যেসব ঘটনা ঘটছে সেসবের অবসানে এবং বিশ্বে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় রুমির শিক্ষা অনুযায়ী তার বিশ্ব দর্শনকে কাজে লাগাতে হবে। আর সেটি হচ্ছে রুমির প্রেমদর্শন, সর্বজনীন প্রেম, বিশ্বজনীন ভালোবাসা। সেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই মানুষ; বিভাজনের কোনো সুযোগ এখানে নেই। রুমি বলেছেন-
কী করা যেতে পারে হে মুসলমান! আমি তো আমাকেই চিনি না
না আমি খ্রিস্টান, ইয়াহুদি- না আমি মুসলমান।
আমি নই হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি অথবা জেন
না আমি ইরাক থেকে না আমি খোরাসানের মৃত্তিকা থেকে
স্থানহীনতায়-ই আমার স্থান আর অনস্তিত্বই আমার অস্তিত্ব
আমি সংযুক্ত আমার প্রিয়তমের সাথে
দেখেছি যেথায় দুটি পৃথিবী একটি হিসেবে
যা ইঙ্গিত দেয় এবং জানায়
প্রথম, শেষ, ভেতর আর বাহির-
এই নিঃশ্বাসের আশ্রয়ে আমি কেবলই মানুষ।
রুমির এই দর্শনকে ধারণ ও অনুসরণ করে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবি হাফিজ শিরাজি গেয়েছেন- ‘না মান হানাফি না মান শাফেয়ি না মান মাজহাবে হাম্বালি দরাম, মা মালেকি হাম না মান মাগার মাজহাবে এশকি দরাম’। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৪ খ্রি.) তার পারস্য প্রতিভা গ্রন্থে এ কবিতার অনুবাদ করেছেন এভাবে-
‘নহিকো হানাফি, শাফি, মালেকি, হাম্বলি
প্রেম মম একধর্ম অন্য নাহি জানি।’
আধুনিক বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের (জন্ম-১৯৩৫ খ্রি.) আমার পরিচয় কবিতায় সেই চেতনাই ফুটে উঠেছে-
‘একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।’
মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ বলেছেন- রুমির মসনভিতে অসাম্প্রদায়িক নীতিবোধের পরম শিক্ষা রয়েছে। কি হিন্দু, কি মুসলিম, কি ইহুদি কি খ্রিস্টান- তত্ত্বপিপাসু মাত্রেই এতে গভীর আনন্দলাভ করতে পারেন। আচার, শাস্ত্রাদেশ বা ধর্মের বাহ্য আবরণ নিয়ে এতে কোনো বাগাড়ম্বর নেই। মানবাত্মা ও পরমাত্মার ভেতরকার শাশ্বত ঐক্য ও প্রেমই এই কাব্যের উপজীব্য। জালালুদ্দিন রুমি সমস্ত বিশ্বমানবকে একই স্রষ্টার সৃষ্ট বলে জানতেন। তার কবিতায়ও সেই বিশ্বজনীন উদারতার প্রতিচ্ছবি প্রস্ফুটিত দেখতে পাওয়া যায়। প্রেমের রাজ্যে যে কোনো জাতি, বর্ণ বা দেশভেদ থাকতে পারে না জালালুদ্দিন রুমি তা অতি পরিষ্কাররূপে দেখিয়েছেন।
এখানে উল্লেখ করা যায়, বিশ্বপ্রেমিক রুমির জানাজার সময় মুসলমানদের সঙ্গে বহু খ্রিস্টান, ইহুদি ও অগ্নি উপাসক উপস্থিত ছিলেন। কেননা তারা সবাই তাকে বন্ধু ও আপনজন মনে করতেন। এটিই হচ্ছে রুমির সর্বজনীন প্রেমের অমোঘ নিদর্শন। রুমির সেই সর্বজনীন প্রেমের সাধনা যে রহস্যময়তার ঘোর তৈরি করেছে তার কবিতার সেই ঘোরে ৮১৫ বছর পরে আজকের আধুনিক মানুষও মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। তাই একটি শান্তিময় সমাজ আর স্বস্তিময় নিরাপদ আবাস গড়তে রুমির প্রাসঙ্গিকতা আজ অনেক বেশি। বিশেষ করে বর্তমানে ধর্মের নামে যে উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদ চলছে, নিরাপরাধ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে বেহেশতে যাওয়া এবং সেখানকার হুর পাওয়ার নিষ্ফল বাসনায় একটি বিপথগামী-বিভ্রান্ত গোষ্ঠী যে পৈশাচিকতা চালাচ্ছে, তা থেকে উত্তরণেও আজ রুমির জীবনদর্শনের অনুসরণ প্রয়োজন।
রুমির কাছে জগৎ শান্তিময়। ভালোবাসা ও ভালোবাসতে শেখা- এরূপ মহৎ চিন্তা প্রেমের রাজ্যে প্রবেশের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলনের সেতুবন্ধন হলো প্রেম। সৃষ্টিকে ভালোবেসে স্রষ্টার ভালোবাসায় উন্নীত হওয়াই রুমির প্রেমদর্শনের মূলকথা। রুমির মতে, পৃথিবীতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাসে সক্ষম। রুমির অন্তর্দৃষ্টি, বচন ও জীবনবোধ মানবহৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়। পৃথিবীতে ক্রমাগত চলতে থাকা সংঘাত-সংঘর্ষ, হিংসা-বিদ্বেষ ও সব ঘৃণাকে চিরতরে নির্বাসন দেয়ার শিক্ষা দেয় রুমির প্রেমদর্শন। রুমির অনুজপ্রতীম প্রেমের আরেক বিখ্যাত কবি হাফিজ শিরাজির প্রেমবিষয়ক একটি কবিতার অংশ এখানে উল্লেখ করতে পারি; যেখানে তিনি বলেছেন, ‘আয সেদায়ে সোখানে এশক না দিদাম খুশতার’ অর্থাৎ প্রেমের কথার চাইতে, প্রেমের আওয়াজের চাইতে মধুরতর আর কোনো কিছু দেখিনি। আমরা সেই বিশ্বপ্রেমিক রুমিকে নিয়ে কথা বলছি; শুধু আমরা কেন, গোটা পৃথিবী আজ রুমিকে নিয়ে মাতোয়ারা। মসজিদের মিম্বর, মাদ্রাসার চৌহর্দি, খানকার মিলন আর ধর্মীয় মাহফিলের বয়ান থেকে শুরু করে সুদূর আমেরিকার ভুবন-বিখ্যাত সংগীত-শিল্পী ম্যাডোনা পর্যন্ত রুমিতে মশগুল; ইউরোপ-আমেরিকায় আজ রুমি অবশ্য-পাঠ্য, আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে রুমি আজ এক অপার বিস্ময়! বিগত কয়েক দশক ধরে খোদ বস্তুবাদী আমেরিকায় শান্তির রুমি বেস্ট সেলার; সর্বোচ্চ জনপ্রিয় কবি ও দার্শনিক। কি প্রাচ্য আর কি প্রতীচ্য- সবখানেই আজ রুমি প্রাসঙ্গিক; রুমি তাদের আপনজন, তাদের জীবন-সংসার আর একাডেমিক ডিসকোর্সের অবধারিত ও অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কেন রুমির এই উপযোগিতা, আর কেনই বা তার এত গ্রহণযোগ্যতা; এক কথায় যদি বলি তাহলে সেটি রুমির শান্তি-দর্শন, প্রেম-দর্শন। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই মহান রব জানেন কিসের মাধ্যমে সৃষ্ট মানুষরা পরিতৃপ্ত হবে, তাদের অন্তরাত্মা প্রশান্ত হবে। তাই তিনি সৃষ্টিকুলের মাঝে ভালোবাসা আর প্রেমের নেয়ামত দিয়ে জগৎকে বিমোহিত করলেন। আর মানুষকে শুধু ভালোবাসা আর প্রেমের সম্পদই দেননি, বরং আশরাফুল মাখলুকাতকে দিয়েছেন পরিশুদ্ধ বিবেক আর চিন্তা-গবেষণার মহান দৌলত। রুমি হলেন মানবকুলের মাঝে সেই অল্প-সংখ্যক মহামানবের অন্যতম, যিনি খোদাপ্রদত্ত অলৌকিক প্রতিভার বরকতে মহান আল্লাহর সেই নেয়ামতকে শনাক্ত করতে পেরেছেন। শুধু শনাক্তই করেননি বরং সমগ্র বিশ্বমানবের জন্য এক ব্যতিক্রমী চিন্তা-দর্শনের খোরাক দিয়ে গেছেন। মানবকুলের আত্মার জন্য রুমির রেখে যাওয়া সেই খোরাককেই আমরা বলছি প্রেমদর্শন; যেটি হলো স্রষ্টা আর সৃষ্টির মাঝে মিলনের এক সেতুবন্ধন। মহব্বত, ভালোবাসা ও প্রেম নানাভাবে রুমির জীবনে, কর্মে ও কাব্য-সাহিত্য রচনায় বাক্সময় হয়ে উঠেছে; যা ধারণ করলে, মেনে চললে আমাদের সামগ্রিক জীবন ও সমাজ হয়ে উঠবে শান্তিময়, প্রেমময়।

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন : চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক; ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]