Bangladesh
This article was added by the user . TheWorldNews is not responsible for the content of the platform.

শেষ আফ্রিকান টিক ওক গাছটি কি মারা গেছে?

প্রাণজগতে শোক কিংবা সুখ সবই স্মৃতি-বিস্মৃতির পাঠ। সেই ৩ লাখ থেকে ৩০ হাজার বছর ধরে প্রজাতি হিসেবে মানুষ স্মৃতি আঁকড়ে বা মুছে বড় হয়েছে। বিবর্তনের দীর্ঘধারায় সব মানুষের সমাজই শোকবিহবল হয়েছে। ইরেকটাস, ডেনিসোভান, ফ্লোরিয়েনসিস, নিয়ানডার্থাল কিংবা আজকের এই স্যাপিয়েন্স আমরা সবাই অগণিত শোকের সাক্ষ্য বহন করে চলেছি। কেবল কি মানুষ; শামুক, মৌমাছি, বনরুই, তরুলতা কিংবা তিমিরও আছে শোক-দিনলিপি। মানুষ কত কী কারণে শোককাতর হয়, তবে সব শোকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কোনো না কোনো স্মৃতি। চলতি আলাপখানিও এক গাছের স্মৃতিকে ঘিরে শোকগাথা। গাছটির জন্ম বা নিবাস এই ভূগোলে নয়। প্রাকৃতিকভাবে এর বিস্তারও ঘটেনি বাংলাদেশে। কিন্তু দীর্ঘসময় এই গাছ বনের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল একা। গড়ে তুলেছিল কত কল্পকথা, কী স্মৃতিভাণ্ডার। ‘আফ্রিকান টিক ওক’ নামের এই গাছ টিকে ছিল লাউয়াছড়া বনে। বনবিভাগের সূত্র উল্লেখ করে সম্প্রতি গণমাধ্যম জানাচ্ছে শেষ গাছটিও মরে গেছে। জানামতে, লাউয়াছড়া বনে গাছ ছিল দুটি। ২০০৬ সালের ঝড়ে অন্যটি নিহত হয়। সদ্যপ্রয়াত এই গাছটির সঙ্গে আমার কিশোর ও তরুণ বয়সের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একটা লম্বা সময় অবধি গাছটি ‘ক্লোরোফরম গাছ’ হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। লম্বা এই গাছের তলে গেলে গা ঝিম ঝিম করে কিংবা এর পাতা নাকেমুখে লাগলে মানুষ অচেতন হয়ে যায়- এমন কল্পকথা প্রচলিত হয়েছিল গাছটি ঘিরে। তখনো লাউয়াছড়ায় পর্যটকের ঢল নামেনি। শ্রীমঙ্গল বা তার আশপাশের কিছু উৎসাহী পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসফরে আসা মানুষের কাছে এই গাছ ছিল লাউয়াছড়ার অন্যতম নিদর্শন। লাউয়াছড়া বনের বুক ফালি করে যাওয়া রেললাইন পেরিয়ে বামের মোড়ের গাছটি নিয়েই ছিল সবার উৎসাহ। আর সদ্যপ্রয়াত লাউয়াছড়ার রাস্তার ছড়ার ধারের গাছটি যেন অনেকটাই ছিল আড়ালে। ডাকবাংলো, বনগবেষণার নার্সারি বা লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জি যতবার গেছি এই গাছ সাক্ষী হয়েছিল।
গাছটির সঙ্গে আমার পয়লা সাক্ষাত ঘটে ১৯৯২ সালের দিকে। আমরা জানতাম এটি ক্লোরোফরম গাছ। এমনকি টিনের পাতে এমন নামও লেখা ছিল। বহুবার গাছের তলে গিয়ে পরীক্ষা করেছি। কুড়িয়ে নিয়েছি ঝরাপাতা। বহুবার মনে হয়েছে শরীর ঝিমঝিম করছে, হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাব। কিন্তু কখনো তা ঘটেনি, কারো কখনো ঘটেছে কিনা তাও শুনিনি। অনেক পরে গাছটির সঠিক উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম টানানো হয়েছিল। গাছটিকে ‘ক্লোরোফরম গাছ’ ভাবার একটা কারণ ছিল বৈকি। এমনিতেও এক অচেনা গাছ, তার ওপর এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ‘ক্লোরোফ্লোরা একসেলসা’। শুনেছি বনবিভাগের স্থানীয় প্রতিনিধিরা গাছটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের প্রথম অংশকে ভুল করে ‘ক্লোরোফরম’ করে ফেলেন আর গাছটিও ‘ক্লোরোফরম গাছ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। মাত্র দুটি হলেও সব বিবেচনায় ভিনদেশি এই গাছ দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হয়ে ওঠে। আজ লাউয়াছড়া বন ১৬৭ থেকে একটি প্রজাতি হারাল। একটি প্রাণপ্রজাতির মৃত্যু মানে বাস্তুতন্ত্রের এক বিশাল শূন্যতা। লাউয়াছড়া বনের ক্ষেত্রে এই গাছের পরিবেশগত অবদান কতখানি তা আমরা খতিয়ে দেখিনি, কিন্তু এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তৈরি হয়েছিল। জানা যায়, ১৯৩০ সালের দিকে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা নাকি গাছটির চারা লাউয়াছড়াতে নিয়ে আসেন। সেসময় প্রাকৃতিক বনের অনেক গাছ কেটে চাপালিশ, সেগুন, গর্জন, লোহাকাঠ, রক্তন চারাও লাগানো হয়। তার মানে এই গাছ ছিল লাউয়াছড়ার শত বছরের সাক্ষী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে। শত বছরের মহামারি দেখেছে। ১৯৯৭ সালে লাউয়াছড়া বনে অক্সিডেন্টালের অগ্নিকাণ্ড সয়েছে। দেখেছে গ্যাস জরিপের নামে ইউনোকল কী শেভরন কীভাবে লণ্ডভণ্ড করেছে লাউয়াছড়া বন। বাংলাদেশে এমন প্রজাতি আর কটিই বা আছে, যা কোনো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে স্মৃতিময় হয়ে দীর্ঘজীবন পার করছে।
দেশের শেষ ‘আফ্রিকান টিক ওক’ গাছটির মৃত্যুর খবর বহু প্রশ্নকে সামনে টেনে এনেছে। মানুষ বা বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হলে চিকিৎসক বা অভিজ্ঞজন পরীক্ষা করে মৃত্যুর খবর জানান। কিন্তু একটি গাছের মৃত্যু বিষয়ে আমরা কীভাবে নিশ্চিত হই? হাতি, বাঘ, ডলফিন, কুমির বন্যপ্রাণী মারা গেলে ময়নাতদন্ত হয়। কিন্তু গাছের কী ময়নাতদন্ত হয়? তাহলে আমরা নিশ্চিত হই কীভাবে একটি গাছ মারা গেছে। গণমাধ্যমে প্রচারিত লাউয়াছড়ার শেষ ‘আফ্রিকান টিক ওক’ গাছটির মৃত্যুর খবরও এসব চিন্তাকে সামনে আনছে। কে, কারা, কীভাবে কোন পরীক্ষা-পদ্ধতির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন গাছটি মারা গেছে তা জানা এবং এর কারিগরি জানা জরুরি। একটি গাছে হয়তো পচন ধরেছে বা রোগাক্রান্ত হয়েছে, ডালপালা শুকিয়ে যাচ্ছে, আগা মরে যাচ্ছে, পুষ্প-পল্লব ঝরে পড়ছে- এসব হয়তো সেই গাছটির মরণের দিকে যাওয়ার কিছু দৃশ্যমান নির্দেশনা। বইয়ের ভাষায় অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্য। একটি গাছের জীবনচক্রে বীজ থেকে অংকুরোগদম হয়ে শিশু চারাগাছ থেকে যৌবনকাল, বার্ধক্য ও মৃত্যু পর্যায় থাকে। একবর্ষজীবী, বহুবর্ষজীবী কিংবা প্রজাতিভেদে এই জীবনকাল ও চক্র ভিন্ন হয়। কিন্তু ‘আফ্রিকান টিক ওকের’ মতো কোনো বৃহৎ বহুবর্ষজীবী বৃক্ষের ক্ষেত্রে এর মৃত্যু সম্পর্কে কীভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি? আবার এটি যখন দেশের কোনো পাবলিক বনের কোনো পাবলিক প্রাণসম্পদ হয়। আলোচ্য শেষ গাছটি কী মৃত্যুর দিকে যাত্রা করেছে নাকি তার মৃত্যু হয়েছে? তাহলে গণমাধ্যম কীভাবে এই গাছের ‘মৃত্যু সংবাদ’ প্রচার করছে? একটি হাতি বা তিমির ক্ষেত্রে প্রামাণ্য দলিল নিয়ে বেশ সতর্কতার সঙ্গে মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হয়। তাহলে একটি গাছের মৃত্যু সংবাদের ক্ষেত্রে কেন এমন সতর্কতা ও প্রামাণ্য দলিল থাকবে না?
আফ্রিকা অঞ্চলে গরষরপরধ বীপবষংধ এবং গরষরপরধ ৎবমরধ এই উভয় বৃক্ষপ্রজাতির কাঠ ‘আফ্রিকান টিক’ নামে পরিচিত। যেমন আমরা সেগুন কাঠকে বলি ‘বার্মিজ টিক’। এই কাঠ খুব শক্তিশালী ও গাঢ় বাদামি বর্ণের। উইপোকা প্রতিরোধী বলে স্থাপনা নির্মাণ, আসবাব, নৌযান, মেঝেতে ব্যবহৃত হয়। মাটির ক্ষয়রোধে এই গাছ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নাইট্রোজেন উৎপাদনকারী এ গাছের পাতা জৈব মালচিং হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গাছের বাকল কফ নিবারণী, হৃদরোগের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। গাছের কষ টিউমার, পাকস্থলী ও গলার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে এটি এক পবিত্র বৃক্ষ। সংরক্ষিত এই গাছের তলে উৎসর্গ ও সমর্পণমূলক কৃত্য পালিত হয়। বিশেষ করে গাছটি উর্বরতা ও নতুন জন্ম সম্পর্কিত কৃত্যের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের লাউয়াছড়াতেও কিন্তু এই গাছ ‘ক্লোরোফরম গাছ’ নামের এক কল্পকথার জন্ম দিয়েছিল। লাউয়াছড়ার পর্যটনে ভূমিকা রেখেছিল।
আহারে নিঃসঙ্গ গাছ!
বাংলাদেশে এমন বহু নিঃসঙ্গ গাছ আছে। কোনোটা অচিন আবার কোনোটা জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ভবনে যেমন টিকে আছে দেশের একমাত্র তালিপাম গাছ। বাইরে থেকে আসা কোনো প্রজাতি যদি কোনো বাস্তুতন্ত্রে প্রতিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে এবং স্থানীয় খাদ্যচক্রে সংকট ঘটায় তখন সেই প্রজাতিটি ‘ইনভেসিভ/এলিয়েন’ হিসেবে পরিগণিত হয়। আমি একে ‘আগ্রাসী প্রজাতি’ নাম দেই। ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২’ ‘আগ্রাসী’ প্রত্যয়টি গ্রহণ করেছে। ইউক্যালিপটাস, ম্যাঞ্জিয়াম, একাশিয়া, শিশু এমন আগ্রাসী প্রজাতির বিরুদ্ধে আমরা বহু বছর ধরে লড়ছি। প্রতিটি প্রজাতিরই একটি জন্মভূমি বা ‘সেন্টার অব অরিজিন’ থাকে। যেমন বেগুনের জন্মভূমি বাংলাদেশ, আলুর পেরু, কৃষ্ণচূড়ার মাদাগাস্কার। দীর্ঘসময় কোনো প্রজাতি বাইরে থেকে এসে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে খাপ খাইয়ে নেয় এবং খাদ্যশেকলের সহায়ক হয়ে ওঠে। আফ্রিকা থেকে এলেও আফ্রিকান টিক ওক গাছটি কোনোভাবেই একাশিয়া বা ইক্যালিপটাসের মতো এই দেশের বাস্তুতন্ত্রে আগ্রাসী নয়। তবে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং প্রতিবেশগত অবদান কতখানি তা গভীর অনুসন্ধান ও মূল্যায়নের বিষয়। বন্যপ্রাণী আইনে এ ধরনের গাছকে ‘স্মারকবৃক্ষ’ বলা হয়েছে এবং এর সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
চিহ্ন সংরক্ষিত হোক
৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ গণমাধ্যমে গাছটির মৃত্যুর কিছু খবর প্রকাশিত হয়। ২০২২ সালের দিকে ছড়ার পাড়ে টিকে থাকা গাছটির পাতা ঝরে যায় ও গোড়ায় পচন ধরে। আর এতেই ধারণা করা হচ্ছে গাছটি মারা গেছে। বনবিভাগ জানায়, বহু চেষ্টা করেও এর বংশবিস্তার করা সম্ভব হয়নি। গাছটির কোনো বীজ ছিল না এবং ফুল ধরলেও ঝরে পড়ে যেত। কাটিং করেও সফল হওয়া যায়নি। শেষ গাছটি মরে গেছে নাকি মরণের প্রান্তে এটি জানা জরুরি। আশা করি রাষ্ট্র দেশের শেষ আফ্রিকান টিক গাছটির বিষয়ে মনোযোগী হবে। ২০০৬ সালে ঝড়ে উপড়ে পড়ার পর প্রথম মৃত গাছটির গুড়ি বনবিভাগ বেশ যতœ করে দর্শনার্থীদের জন্য রক্ষা করেছে। লাউয়াছড়ার পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘর ও পাবলিক সংগ্রহশালায় শেষ গাছটির অংশবিশেষ স্মৃতিস্মারক হিসেবে সংরক্ষণ করা জরুরি।

পাভেল পার্থ : লেখক ও গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
[email protected]