নিয়ম মেনে কাজ করলে সরকার দেশে আবিষ্কৃত ট্রায়াল পর্যায়ে থাকা করোনা ভাইরাসের টিকা ব্যানকোভিডকে পৃষ্ঠপোষকতার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানিয়েছেন গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরি অপারেশন বিভাগের ব্যবস্থাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। তিনি জানান, গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তেজগাঁও গ্লোব বায়োটেকের কার্যালয় পরিদর্শন শেষে এ আশ্বাস দেন। প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন ওধুষ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। গ্লোব বায়োটেকের ড. মহিউদ্দিন জানান, আমাদের আবিষ্কৃত টিকাটির বর্তমান
নাম ব্যানকোভিডের পরিবর্তে বঙ্গভ্যাকস রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন সচিব।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে দেশে আবিষ্কৃত এ ভ্যাকসিনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। তাই নিয়ম মেনে কাজ করলে পাশে থাকবে সরকার। প্রয়োজনে পরবর্তী ধাপে যুক্ত হবে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। দেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। তাই তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা (গ্লোব বায়োটেক) সারাবিশ্বে এটির নাম পরিবর্তন করে বঙ্গভ্যাকস দেবে।’
আমদানি করা ৩ কোটি ডোজ করোনার টিকা দেশের দেড় কোটি মানুষকে দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেন সচিব। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রচুর জনসংখ্যা পড়ে রয়েছে। এদের সবাইকে যখন ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পন নেব, তখন দেশের ভ্যাকসিনের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। যত দ্রুত এ বিষয়ে দেশের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া যায় আমরা নেব।’
অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম বলেন, ‘নিয়ম মেনে কাজ করলে পরবর্তী প্রতিটি ধাপেই পাশে থাকবে সরকার। প্রয়োজনে সার্বিক সহায়তায় থাকবে আইইডিসিআর। ভ্যাকসিন তৈরির জন্য নিয়মতান্ত্রিক কাজগুলো তাদের করতেই হবে। সেটা করার ক্ষেত্রে তাদের যেসব সহযোগিতার প্রয়োজন হবে আমরা অবশ্যই করব।’
এদিকে নিজেদের আবিষ্কৃত টিকা ব্যানকোভিডের হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল তা বাতিল করেছে গ্লোব বায়োটেক। আইসিডিডিআরবির পরিবর্তে এখন গ্লোব সিআরও বাংলাদেশ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এর হিউম্যান ট্রায়াল করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আইসিডিডিআরবিকে চিঠি দিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ না করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে গ্লোব।
গ্লোবের ড. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ব্যানকোভিডের হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য গত ১৪ অক্টোবর আইসিডিডিআরবির সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। কথা ছিল আইসিডিডিআরবি ব্যানকোভিডের সিআরও (কন্ট্রাক্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন) হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য তারও আগে ২৯ আগস্ট থেকে তাদের সঙ্গে আমাদের কাজ হচ্ছিল অনানুষ্ঠানিকভাবে। আমাদের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ছিল, ৩০ দিনের ভেতরে তারা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় দেড় মাস পরও আইসিডিডিআরবি এ বিষয়ে কাজ শুরু করেনি। বরং প্রটোকল তৈরি থেকে শুরু করে সবকিছু আমরা করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোনো অগ্রগতি নাই, অথচ এ তিন মাসে প্রায় ৯টির মতো মিটিং হয়েছে। আমরা বুঝতে পেরেছি, তারা যেহেতু বিদেশি সংস্থার সহযোগিতায় পরিচালিত হয়, তাই তারা যাদের ফান্ডে চলে তাদের স্বার্থই আগে দেখবে। একই সঙ্গে আইসিডিডিআরবির প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করার অভিজ্ঞতা নেই। এর আগে তারা সব ট্রায়াল করেছে তৃতীয় ধাপের। সম্প্রতি চীনের সিনোভ্যাকের সঙ্গে যে চুক্তি হয় সেটাও তৃতীয় ধাপের ছিল। আর তাদের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় আমরা বুঝতে পেরেছি, আমাদের ট্রায়ালের জন্য উপযুক্ত সিআরও তারা নয়। তাই আমরা তাদের জন্য আর অপেক্ষা করছি না। চিঠি দিয়ে এটা জানানো হয়েছে তাদের।’
ড. মহিউদ্দিন আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য সচিব আমাদের বলেছেন আইইডিসিআরের মাধ্যমে যদি নতুন সিআরও চাই, অন্যান্য সিআরওর সঙ্গেও কাজ করার সুযোগ রয়েছে আমাদের। সচিব আইইডিসিআরের পরার্মশ অনুযায়ী বাংলাদেশে যারা এ ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে পারে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করতে বলেছেন। তবে ইতোমধ্যেই গ্লোব বায়োটেক সিআরও বাংলাদেশ নামের একটি সংস্থার সঙ্গে এ বিষয়ে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। সিআরও বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, তারা আমাদের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে চায়। আইইডিসিআরের পরামর্শ নিয়ে আমরা আশা করছি, খুব দ্রুততম সময়ে আমাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পারব।’
বিষয়টি নিয়ে আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। সংস্থাটির মিডিয়া ম্যানেজার তারিফ হাসানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবি এখন কোনো কথা বলবে না।
গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড একমাত্র বাংলাদেশি কোম্পানি, যার টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সারা বিশ্বে যেসব টিকা তৈরির কাজ হচ্ছে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করছে ডব্লিউএইচও। এর মধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে আছে এমন ৪২টি টিকার একটি তালিকা এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আগের অবস্থায় (প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) থাকা ১৫৬টি টিকার আরেকটি তালিকা রয়েছে সংস্থাটির কাছে। ওই তালিকায় গ্লোব বায়োটেকের তিনটি টিকার নাম রয়েছে। গত ৩ জুলাই তেজগাঁওয়ে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে গ্লোব বায়োটেকের পক্ষ থেকে করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরির চেষ্টার ঘোষণা দেওয়া হয়।
৫ অক্টোবর আরেক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে ‘ব্যানকোভিড’ নামে টিকাটি কার্যকর ও সম্পূর্ণ নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। এখন তারা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদে (বিএমআসি) আবেদন করবে। এর পর ১৪ অক্টোবর টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য আইসিডিডিআরবির সঙ্গে গ্লোব বায়োটেকের এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। পরে সম্ভাব্য এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে নেপালও আগ্রহ দেখায়।